প্রজন্মের দীপশিখা by বোরহান উদ্দিন

ন্ধ্যাবেলার নীলাভ আকাশে কোটি তারকা, পূর্বাকাশে পূর্ণ চন্দ্রিমার দৃশ্যমান এক উজ্জ্বল আলোকমণ্ডিত পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠে দূর্বাঘাসের ওপর শিশির যেন হীরার মতো চকচক করছে। ওই রাতেরই কোনো একসময় গর্ভবতী মা সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার অপেক্ষায়। তার সন্তান প্রসবকাল আসন্ন। অবশেষে ভূমিষ্ঠ হলো একটি শিশু। যেদিন জন্ম নিল শিশুটি দিনটি ছিল ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট, শেষ রাতে ফেনীর সোনাগাজীর সেনেরখীল গ্রামে।


এ সন্তানটি আর কেউ নয় মা ফিরোজা খাতুনের প্রথম পুত্রসন্তান। ফুটফুটে একটি শিশু। মা তার নাম রাখলেন মঈন উদ্দিন আহমেদ; ডাকনাম 'সেলিম'।
এই লিকলিকে সেলিম যতই বড় হতে লাগলেন, অন্যদের চেয়ে বেশি অস্থির করে তুললেন মাকে। অতি অল্প বয়স (তিন-চার বছর) থেকেই লেখাপড়ার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। পড়ালেখার বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হলো। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন সিলেটের বড়লেখার সিংহ গ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বাবার চাকরির সুবাদে তারা সেখানে ছিলেন। চা বাগানের মালিকের পোষা হাতি ছিল। হাতির পিঠে চড়ে সেই অদম্য সাহসী দুষ্টু ছোট্ট ছেলেটি উচ্ছ্বাসে মেতে উঠত।
সেলিম ছিল ডানপিটে। কোনো ছেলেকে পেলে হয় তাকে বেত্রাঘাত করত। নয়তো কাদা মাখিয়ে একসা করে ছাড়ত। এসব নিয়ে আবার মায়ের কাছে নালিশ আসত। এদিকে নিজ পাঠ্যবইয়ের চেয়ে উপন্যাস আর কবিতার বই পড়ে বেশি সময় কাটাত সেলিম। স্কুলজীবন শেষে ফেনী কলেজ, অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হলেন সেলিম। পড়ালেখার মাঝেও কবিতা, গল্প লেখায় অনেকটা সময় কাটাত তার। এর মধ্যে অধ্যাপক আহমদ শরীফ ও অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পরামর্শে কবিতা এবং উপন্যাস লেখা ছেড়ে নাটক লেখা শুরু করলেন তিনি। প্রতিটি নাটকই অভাবিত সাফল্য অর্জন করতে লাগল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকা শহরে তার লেখা নাটক একের পর একটি মঞ্চস্থ হয়ে খ্যাতির শিখরে আরোহণ করেছে। নাটক রচনা করে দর্শকদের কাছে নন্দিত হতে লাগলেন সেলিম। ১৯৬৮ সালে বেতারে তার নাটক 'বিপরীত তমসায়' এবং পরে 'জণ্ডিস ও বিবিধ বেলুন' প্রচারিত হওয়ার পর 'সংবাদ কার্টুন'সহ কয়েকটি নাটক তাকে দর্শক-শ্রোতামহলে জনপ্রিয়তার শীর্ষ আসনে অধিষ্ঠিত করে। 'কির্তনখোলা', 'হাতহদাই'সহ অন্যান্য নাটকে তিনি গ্রামীণ রাজনৈতিক ও সামাজিক পটপরিবর্তনের চিত্র বাস্তবরূপে তুলে ধরেছেন।
এ লেখক অনেক সৃষ্টিকর্মের ফসল ফলিয়েছেন আগামী প্রজন্মের জন্য, যারা সমাজ, রাজনীতি ও গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে মিশে নতুন করে তৈরি করবে অনবদ্য রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থা। এ জন্যই তিনি সত্তরের দশকে গ্রাম থিয়েটার সৃষ্টি করেন গ্রামের মানুষকে জাগরিত করার জন্য। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে ভারতে খাজা আহমেদের সঙ্গে পত্রিকায় কাজ করেছেন। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রামে এসে সেনেরখীলকে হানাদারমুক্ত রাখতে নেতৃত্ব দেন পাকিস্তান বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণের পূর্বপর্যন্ত।
এ অপরিসীম সাহসী মানুষটিকে ২০০৮ সালের ১২ জানুয়ারি প্রথমে বারডেম হাসপাতালে এবং পরে সংকটাপন্ন অবস্থায় বারডেম কার্ডিয়াক হাসপাতালে ভর্তি করতে প্রাণান্ত চেষ্ট চালিয়ে কর্তৃপক্ষের অপারগতা ও অমানবিকতার কারণে ব্যর্থ হয়ে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। দু'দিন মৃত্যুদূতের সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে ১৪ জানুয়ারি তিনি চিরদিনের জন্য এ জগতের পাট চুকিয়ে ফেলেন। এ খ্যাতিমান ব্যক্তিটি শেষ শয্যা নিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পেছনে তার অতিপছন্দের নিমগাছটির নিচে; কিন্তু অত্যন্ত অবহেলায়। এ ব্যক্তিটির সমাধি কী অবস্থায় আছে জিজ্ঞাসা করেনি কেউ কখনও। বর্তমানে তার কবরটি বাঁশের কঞ্চি দিয়ে চিহ্নিত।
যারা একসময় সেলিম আল দীনের আশীর্বাদ নিয়েছেন, তাদের মধ্যে এমন কোনো ভক্ত কি নেই যিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় বা নিজে উদ্যোগী হয়ে অচিহ্নিত স্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত দু'বাংলার এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এ সাহিত্যিক ও নাট্যকারের সমাধিটি সুসজ্জিত করে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা নেবেন? যদি আপনাদের জবাব সম্মতিসূচক হয় তবে আহ্বান জানাচ্ছি, হিতার্থীরা এগিয়ে আসুন।

বোরহান উদ্দিন : সেলিম আল দীনের কনিষ্ঠ ভ্রাতা
borhanuddin09@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.