বিচারবহির্ভূত হত্যা শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয়, সীমান্তেও উদ্বেগজনক by কুতুব উদ্দিন প্রধান

র্তমান সরকারের নির্বাচনী ওয়াদায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুধু বন্ধই নয়; বিগত সময়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা যেসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, তা তদন্তপূর্বক আইনের মুখোমুখি করা হবে উল্লেখ ছিল। নির্বাচনী ইশতেহারে অনেক সুন্দর কথার মধ্যে এ সুন্দর কথায় দেশবাসী আশ্বস্ত ছিল।
মহাজোট সরকার গঠনের পর ওয়াদা অনুযায়ী অন্তত বিচার ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে কাউকে প্রাণ দিতে হবে না— অনেকেই এমনটা আশা করেছিল। বিপুল ভোটে মহাজোট জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে এখন এক বছর সময় অতিবাহিত করতে যাচ্ছে; কিন্তু সে কাজটি করতে বর্তমান সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলো। আগের সরকারগুলোর মতো যথারীতি হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে র্যাব ও পুলিশ। ক্রসফায়ারের নামে যে নাটকটি তারা করে তা হলো কোনো অপরাধী বা সন্ত্রাসী যারা হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি তাদের গ্রেফতার করে অস্ত্র উদ্ধারের নামে আসামির স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সে এলাকায় নিয়ে যায়। সেখানে আগে থেকে ওঁত্ পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা র্যাব ও পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। গুলিবিনিময়ের মধ্যখানে গ্রেফতারকৃত আসামি ক্রসফায়ারে মারা যায়। সেখান থেকে উদ্ধার হয় অস্ত্র, গুলির খোসা, রাম দা ইত্যাদি। বরাবরই এ কথাগুলো পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টার নাটকটি গতানুগতিক, পুরনো। এই নাটকের রিহার্সাল ও মঞ্চস্থ পর্যন্ত দেশবাসীর এরই মধ্যে বোধগম্য হয়েছে। স্কুল-কলেজের ছাত্র ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়ে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে, যা আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি। আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছি, ক্রসফায়ারের ঘটনায় মাদারীপুরে চরমপন্থী দুই ভাই নিহত। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো, নিহত লুত্ফর খালাসী ওরফে জহিরের ছেলে বাবলু খালাসী তার বাবা ও চাচা ক্রসফায়ারের শিকার হতে পারেন আশঙ্কায় আগের দিন শনিবারে স্থানীয় একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করেন। শেষ পর্যন্ত ছেলের আশঙ্কাটি বাস্তবে পরিণত হলো। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নিষিদ্ধ ঘোষিত কয়েকটি সংগঠনের সশস্ত্র নেতাকর্মীরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি ও প্রভাব বিস্তারের জন্য খুন, ডাকাতি, সন্ত্রাস, জবরদখল ও অপহরণসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজ দীর্ঘদিন যাবত করে আসছে। এমন খবর পত্রিকার পাতায় দেখা গেছে, ওদের উত্থানের পেছনে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের হাত ছিল। সেই এলাকার নেতারা ক্ষমতায় আসার জন্য তাদের সাহায্য নিয়েছেন এবং তাদের ব্যবহার করেছেন। ক্ষমতায় আসার পর সেই নেতা সঙ্গত কারণে অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেননি। নানাবিধ কারণে অস্ত্রও উদ্ধার হয়নি এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেনি। ক্ষমতাসীনদের ছায়াতলে থেকেই তারা দিনের পর দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সেই অঞ্চলের অনেক নিষিদ্ধ ঘোষিত দলের সশস্ত্র নেতাকর্মীদের অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করিয়েছেন তত্কালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোঃ নাসিম। বর্তমানে সরকারের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ চলমান প্রক্রিয়ায় শুধু হত্যাই বৃদ্ধি পাচ্ছে না, আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি বা এই সঙ্কটের একশ’ ভাগ সমাধান হচ্ছে বলে মনে হয় না। আইনের শাসনে বিচার ছাড়া কাউকে হত্যা করার মানে হলো একটি অপরাধ বন্ধ করতে আরেকটি নতুন অপরাধ সংঘটিত করা। আইনের দৃষ্টিতে এ দুই-ই অপরাধ। তাই ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টার বন্ধ করে বিচারের মাধ্যমে শাস্তির বিধান করাই শ্রেয়। দেশের সীমান্তে অহরহ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দ্বারা হত্যাকাণ্ড চলছে। বিএসএফ পাখির মতো গুলি করে নিরপরাধ বা নিরীহ মানুষকে মারছে, তার আত্মীয়-স্বজনরাও জানতে পারেনি কী অপরাধে তাকে খুন করা হলো। মানবাধিকার (অধিকার) তথ্য অনুযায়ী, ১ জানুয়ারি থেকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত সাড়ে ১০ মাসে একানব্বই জন বাংলাদেশী খুন, ২০০১ সাল থেকে ১৪ নভেম্বর ২০০৯ পর্যন্ত বিএসএফের হাতে খুন হয়েছে ৮২১ জন, আহত হয়েছে ৮৫৮ জন এবং অপহৃত হয়েছে ৯০৩ জন। এতসব ঘটনায় মানবাধিকার (অধিকার) মনে করে, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে সীমান্তে এই নরহত্যা চালাচ্ছে এবং তারা এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ সরকারের উচিত ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি তুলে ধরে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিচার ও ক্ষতিপূরণ দাবি জানাতে আহ্বান জানিয়েছে অধিকার। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বসে তার একটি সুরাহা করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন দেশবাসী।
লেখক : মানবাধিকার কর্মী

No comments

Powered by Blogger.