আখেরি মোনাজাত আজ, তুরাগ তীরে মুসল্লির ঢল

ইকবাল আহমদ সরকার/ এম,এ হায়দার সরকার, টঙ্গী থেকে ফিরে: লাখো মুসল্লির জিকির-আজকার ও তাবলীগের শীর্ষ মুরব্বিদের তাৎপর্যপূর্ণ বয়ানের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে গতকাল বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয়  পৃষ্ঠা ৮ কলাম ১
দিন অতিবাহিত হয়েছে। মুসল্লিদের জিকির-আজকার আর ইবাদত-বন্দেগীতে টঙ্গীর তুরাগ তীরের বিশাল এলাকা পবিত্র পুণ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। আজ দুপুরে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটবে বিশ্ব তাবলীগ জামাতের ৪৭তম ইজতেমার প্রথম পর্ব।
আখেরি মোনাজাতে প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা এবং মুসলিম বিশ্বের কূটনীতিকরা অংশ নেবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য ইজতেমা ময়দানের পূর্ব পাশে বাটা সু ফ্যাক্টরিতে ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্য এটলাস হোন্ডা ফ্যাক্টরিতে বিশেষ মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান ইজতেমার মূল মঞ্চের পাশে স্থাপিত বিশেষ মঞ্চে অবস্থান নিয়ে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেবেন বলে জানা গেছে।
বয়ান ও মোনাজাত: তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি ভারতের মাওলানা যোবায়েরুল হাসান আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করবেন। গতকাল ফজরের পর মুসল্লিদের উদ্দেশে বয়ান শুরু করেন পাকিস্তানের মাওলানা মো. এহসান, জোহরের পর বাংলাদেশের মাওলানা নুরুল হক, আসরের পর তাবলিগ মারকাজের বর্তমান প্রধান দিল্লির হজরত মওলানা যোবায়েরুল হাসান এবং মাগরিব নামাজের পর ভারতের আহম্মদ লাট বয়ান করেন। রোববার সকাল থেকে মোনাজাতের আগ পর্যন্ত চলবে হেদায়েতি বয়ান। অন্য যে কোন বছরের তুলনায় এবার ইজতেমা ময়দানে অধিক সংখ্যক মুসল্লির সমাবেশ ঘটেছে।
ইবাদত-বন্দেগীর পরিবেশ: ইজতেমাস্থল ঘুরে ময়দানের চারদিকে শুধু ইবাদত-বন্দেগীর পরিবেশ  দেখা যায়। ধনী-গরিব নির্বিশেষে দেশ-বিদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ সুবিশাল প্যান্ডেলের নিচে মহান আল্লাহ তায়ালার জিকিরে মশগুল ছিলেন। যাতায়াত, থাকা-খাওয়া, বিশ্রাম, টয়লেট ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নানা অসুবিধা সত্ত্বেও ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ নীরবে আল্লাহকে খুশি করতে যেন নিবেদিত ছিলেন সবাই।
ঈমান, আমল ও দাওয়াতের বয়ান: বিভিন্ন সময়ে দেশ-বিদেশের শীর্ষস্থানীয় তাবলীগ জামাতের মুরব্বিগণ ঈমান, আমল ও দাওয়াতের মেহনত সম্পর্কে বয়ান করেন। বয়ানে তারা বলেন, দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াবির একমাত্র তরিকা হচ্ছে ঈমান ও আমলের মেহনত করা। তারা পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর যথার্থ অনুসরণ-অনুশীলনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, দুনিয়াতে শান্তি ও আখেরাতে মুক্তি পাওয়ার এটাই একমাত্র পথ। মানব জাতিকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে অতি উচ্চ মর্যাদা দিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। দাওয়াতে তাবলীগের মেহনত ছাড়া ঈমান জিন্দাহ থাকে না উল্লেখ করে আলেমগণ বলেন, জিন্দেগির প্রতিটি কাজ করতে হবে আল্লাহর হুকুম ও হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর তরিকা মোতাবেক। বয়ানে ঈমানি শক্তির ওপর গুরুত্বারোপ করে তাবলীগের মুরব্বিগণ বলেন, মহান আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসুল (সা.) প্রদর্শিত পথই হতে হবে মোমেনদের একমাত্র পাথেয়। যার ঈমানি শক্তি যতো বেশি, সে ততো বেশি দ্রুত আখেরাতের পুলসিরাত পার হয়ে বেহেশতে যাবে এবং বেহেশতের পরিপূর্ণ নিয়ামত পাবে। তাই দ্বীনের ওপর চললে দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াবি হওয়া যাবে। নিজের ইচ্ছামতো না চলে আল্লাহর হুকুম মতো চললে আল্লাহ পুরো কামিয়াবি দান করবেন। আল্লাহ মোমেনদের যেসব নেয়ামত প্রদানের ওয়াদা করেছেন, পরিপূর্ণ আমল করলেই সেসব নেয়ামত পাওয়া যাবে। আমল ভাল না হলে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে পরিণতি খারাপ হয়ে যেতে পারে। মাওলানাগণ ইজতেমায় সমবেত তাবলীগ অনুসারীদের উদ্দেশে বলেন, দুনিয়ার সর্বক্ষেত্রে ধর্মীয় পরিবেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। মানুষ সবচেয়ে বেশি আনন্দ উপভোগের সময় নিজেকে ছাড়া সবকিছু ভুলে যায়। রাসুল (সা.)-এর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্তটি ছিল আল্লাহর নৈকট্য লাভের সময়। কিন্তু তিনি তখনো তার উম্মতের কথা ভুলে যাননি।
যৌতুকবিহীন বিয়ে: ইজতেমার রেওয়াজ অনুসারে এখানে প্রতিবছর দ্বিতীয় দিন বাদ আছর যৌতুকবিহীন বিয়ের আসর বসে। অভিভাবকরা আগেই নবদম্পতিদের নাম তালিকাভুক্ত করেন। প্রতিবারের মতো ইজতেমার দ্বিতীয় দিনে শনিবার বিকালে ইজতেমাস্থলে হজরত ফাতেমা (রা.) ও হজরত আলীর (রা.) বিয়ের দেনমোহর অনুসারে  যৌতুকবিহীন বিয়ে সম্পন্ন হয়।
ইজতেমার মূল মঞ্চে কনের অভিভাবক ও বরের উপস্থিতিতে আসরের নামাজের আগে অর্ধশতাধিক জোড়া বর-কনের বিয়ে যৌতুকবিহীন পড়ানো হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বিয়ে শেষে মঞ্চে খেজুর ও মিষ্টি বিতরণ করা হয়।
গোয়েন্দাদের তীক্ষ্ন নজরদারি: বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে নিরাপত্তার বলয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে গোটা টঙ্গী শিল্প নগরী। পুরো টঙ্গী এখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গোয়েন্দা সদস্যদের তীক্ষ্ন নজরদারিতে রয়েছে। টঙ্গীর ২৫টি স্কুল-কলেজ এখন পুলিশ ব্যাটালিয়ন আনসারসহ বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তা কর্মীদের আবাসকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্বে কাজ করছেন প্রায় ১০ হাজার নিরাপত্তা কর্মী। মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে র‌্যাব সদস্যরা চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহনে তল্লাশি চালাচ্ছে ইজতেমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। র‌্যাব তাদের কন্ট্রোল রুম থেকে ৬০টি সিসি টিভির পাশাপাশি মুভি ক্যামেরার মাধ্যমে গোটা মাঠ মনিটরিং করছে । সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সদস্যরা প্যান্ডেলের বিভিন্ন খিত্তায় বিচরণ করছেন। র‌্যাবের তুরাগ নদীতে স্পিডবোট ও আকাশে হেলিকপ্টারের বিশেষ টহল অব্যাহত রয়েছে। তাবলীগের বিদেশী মুসল্লিগণও সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা নিয়ে সন্তুষ্ট। তারা বলছেন, বাংলাদেশের ইজতেমায় এসে সবাই খুশি।
পুলিশ প্রশাসন প্যান্ডেলের ভেতরে নাশকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যাতে অপ্রত্যাশিত লোকজন ঢুকতে না পারে, সে জন্য সাদা পোশাকে গোয়েন্দ নিয়োগ করেছে। সবুজ টুপি পরা প্রায় হাজার খানেক সাদা পোশাকি পুলিশ ইজতেমার গেইটে এবং ভেতরে তল্লাশি চালচ্ছে। পুলিশ, র‌্যাব ও ইজতেমার নিজস্ব পাহারাদারগণ মাঠের চারদিকে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার জন্য নিরলস পরিশ্রম করছেন। ইজতেমা মাঠ ও আশপাশের এলাকা থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা শুক্রবার রাত ও শনিবার বিকালে কমপক্ষে ১৫ পকেটমার ও সন্দেহজনক লোকজনকে আটক করেছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে শনিবার দুপুরে ইজতেমা মাঠ সংলগ্ন পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়। এতে ব্রিফিং দেন পুলিশের ডিআইজি মো. আসাদুজ্জামান মিয়া। এ সময় সংসদ সদস্য আকম মোজাম্মেল হক ও জাহিদ আহসান রাসেল বক্তব্য রাখেন।
মহিলাদের ভিড়: বিশ্ব ইজতেমায় মহিলাদের অংশগ্রহণ ও অবস্থানের কোন সুযোগ নেই। তাদের জন্য কোন প্যান্ডেল তো দূরের কথা ইজতেমায় আসার ব্যাপারে আয়োজক কর্তৃপক্ষের বিধি-নিষেধও রয়েছে। তারপরও আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে দূর-দূরান্ত থেকে এসে হাজার হাজার মহিলা ইজতেমা মাঠের বাইরে, আত্মীয়-স্বজনের বাসায় বিশেষ করে তুরাগ নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থান নিয়েছেন। তাদের অনেকেই ঠাঁই নিয়েছেন খোলা আকাশের নিচে।
আরও ২ মুসল্লির মৃত্যু : ইজতেমা ময়দানে আব্দুল মজিদ (৬৫) ও শফিউল্লাহ চৌধুরী নামের আরও ২ মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। মজিদের বাড়ি বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জের চাদপাশা গ্রামে। বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু হলে শুক্রবার এশার নামাজের পর জানাজা শেষে রাতেই লাশ গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয় । শফিউল্লাহর বাড়ি ভোলা জেলার দৌলতখান তানার চরপাতা গ্রামে।
সাড়ে ১৭ হাজার বিদেশী মুসল্লি: শনিবার দুুপুর পর্যন্ত ৮০টি দেশের প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার বিদেশী মুসল্লি ইজতেমাস্থলে এসেছেন। বিভিন্ন ভাষাভাষী ও মহাদেশ অনুসারে ইজতেমা ময়দানে বিদেশী মেহমানদের জন্য প্রায় ৩০টি তাঁবু নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে তাদের জন্য কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী, সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ, টেলিফোন, মেডিকেল জামাত, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে।
ঘরে ঘরে মেহমান: টঙ্গীর ঘরে ঘরে এখন ইজতেমার মেহমান। অনেক সময় দাওয়াত দিয়েও যাদের আনা সম্ভব হয় না, তাদের অনেকে আখেরি  মোনাজাতে অংশ নিতে এসে টঙ্গীতে আত্মীয়ের বাসায় উঠেছেন। আর বাড়তি আত্মীয়দের পেয়ে কারোরই ক্লান্তি নেই যেন মেহমানদারিতে। অনেক বাসাবাড়িতে এজন্য আলাদা প্রস্তুতিও রয়েছে।
অস্থায়ী বাজার জমে উঠেছে: বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে মুসল্লিদের সুবিধার্থে ইজতেমা ময়দানের আশপাশে গড়ে উঠেছে ৫টি অস্থায়ী বাজার। এখানে পাওয়া যাচ্ছে প্রয়োজনীয় সবকিছুই। মন্নু টেক্সটাইল, অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিলস, সেনাকল্যাণ ভবন সংলগ্ন মাঠ, কামারপাড়াসহ এসব অস্থায়ী বাজারে বালিশ-কম্বল, জুতা-সেন্ডেল, পাজামা-পাঞ্জাবি, টুপি, হাঁড়ি-পাতিল, চুলা, শীতবস্ত্র, কাঁচা বাজারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুই পাওয়া যাচ্ছে। তবে এসব বাজারে বেশি দরে পণ্য বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
হোগলা পাটির বাজার: বছরের অন্য সময়  হোগলার চাটাইয়ের তেমন কদর না থাকলেও ইজতেমা উপলক্ষে এর দাম বেড়ে গেছে।  নোয়াখালীর নাছিরডুগী এলাকা থেকে অনেক ব্যবসায়ী এই চাটাই নিয়ে এসেছেন ইজতেমায় বিক্রির জন্য। ছোট থেকে বড় সাইজের প্রতিটি চাটাই ৩০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.