জারদারিকে কিয়ানির শর্ত

নবজমিন ডেস্ক: টান টান উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে এক টেবিলে মুখোমুখি বসলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি ও সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক পারভেজ কিয়ানি। প্রেসিডেন্টকে কিয়ানি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন তার ক্ষোভের কথা। বললেন- মেমোগেট কেলেঙ্কারি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি সেনাপ্রধান ও আইএসআই প্রধানকে জড়িয়ে চীনা একটি পত্রিকাকে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে তার আপত্তি আছে। প্রধানমন্ত্রীকে ওই বক্তব্য প্রত্যাহার করে নতুন বিবৃতি দিতে হবে। তার এ শর্তের জবাবে প্রেসিডেন্ট জারদারি কি বলেছেন তা জানা যায় নি। অনলাইন ডন জানায়, গতকাল মেমোগেট কেলেঙ্কারি ও জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধানের মধ্যে এক ঘণ্টার উপরে আলোচনা হয়। সেনাপ্রধানের আহ্বানে তারা দু’জন মুখোমুখি বসেন। মেমোগেট নিয়ে সেনাপ্রধান ও আইএসআই প্রধান পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে বিবৃতি দেয়ার পর প্রধানমন্ত্রী তাদের এ কাজকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে চীনের একটি পত্রিকায় বিবৃতি দেন। এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সেনাবাহিনী। ওদিকে, পাকিস্তানে অভ্যুত্থান আতঙ্কে সরকার এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, বারবারই তারা অভ্যুত্থান ঠেকাতে বিদেশী হস্তক্ষেপ কামনা করছে। এ ধারায় প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির পর যুক্ত হলেন প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি। তিনি সরকারকে বাঁচাতে সহায়তা চেয়েছেন যুক্তরাজ্যের। গত বছর ২রা মে ইসলামাবাদের অ্যাবোটাবাদে আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে যুক্তরাষ্ট্র হত্যা করার পর সামরিক অভ্যুত্থান আতঙ্কে ছিলেন প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি। তিনি তখন একটি চিরকুটের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চেয়েছিলেন। এ ঘটনাই সেখানে মেমোগেট কেলেঙ্কারি নামে পরিচিত এবং পাকিস্তান সঙ্কটের শুরু এখান থেকেই। এরপর সেই একই অভ্যুত্থান আতঙ্কে প্রধানমন্ত্রী গিলানি চাইলেন যুক্তরাজ্যের সহায়তা। গত সপ্তাহে পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থানের আলামত তৈরি হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী তড়িঘড়ি ফোন করেন ইসলামাবাদে বৃটিশ হাইকমিশনারকে। তার মাধ্যমে অভ্যুত্থান ঠেকাতে সহায়তা চান যুক্তরাজ্যের। কিন্তু বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ পাকিস্তানবাসীকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন, যদিও দেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটার আশঙ্কা বাড়ছে। উইলিয়াম হেগ বলেছেন, পাকিস্তানে যেহেতু উত্তেজনা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। সেখানে প্রচণ্ড ঝুঁকি আছে। এ অবস্থায় আমরা তা নিয়ে কোন কথা বলবো না। আমরা সরাসরি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবো না। এই রাজনৈতিক লড়াইয়ে আমরা কোন পক্ষ নিতে যাবো না। এটা পাকিস্তানের জনগণকে নির্ধারণ করতে হবে। বার্তা সংস্থা এপি’র উদ্ধৃতি দিয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, ইসলামাবাদে বৃটিশ এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অভ্যুত্থান প্রায় ঘটে চলেছে এমন এক সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী গিলানি বৃটিশ শীর্ষ কূটনীতিককে ফোন করেন। তার মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের সহায়তা চান। তিনি ফোন করেন ইসলামাবাদে নিযোজিত বৃটিশ হাইকমিশনার অ্যাডাম থমসনকে। তবে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক পারভেজ কিয়ানির সামরিক অভ্যুত্থানের দিকে তেমন ঝোঁক নেই বলে মনে করেন বেশির ভাগ বিশ্লেষক। তারা মনে করেন, কিয়ানি খুশি হবেন যদি সাংবিধানিক উপায়ে সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে বরখাস্ত করে। আর এ জন্যই সুপ্রিম কোর্ট প্রেসিডেন্ট জারদারিসহ কয়েক শ’ রাজনীতিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাগুলো পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সরকারকে চাপ দিয়েছে। এই সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্ট তাদেরকে হুমকি দিয়েছে, মামলাগুলো নিয়ে তারা প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করতে পারে। এমনই এক অবস্থায় বেআইনি কর্মকাণ্ডের অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী গিলানি বরখাস্ত করেন প্রতিরক্ষা সচিব লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) নাঈম খালিদ লোদিকে, যিনি সেনাপ্রধান কিয়ানির ডানহাত বলে পরিচিত। তাকে বরখাস্তের পরই সেনাবাহিনী প্রধান কিয়ানি কোর কমান্ডারদের জরুরি সভা আহ্বান করেন। এ সময় দেশে-বিদেশে অভ্যুত্থান আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ঠিক এ সময়ই প্রধানমন্ত্রী গিলানি ফোন করেন বৃটিশ হাইকমিশনারকে। প্রায় সবারই এখন জানা হয়ে গেছে, প্রেসিডেন্ট জারদারি ও প্রধানমন্ত্রী গিলানির বেসামরিক সরকারকে পছন্দ নয় সামরিক বাহিনীর। পাকিস্তানের ইতিহাসে এ যাবৎ চারবার সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে গেছে। সেনাবাহিনী নিজেদের সেখানে সত্যিকার অর্থে একমাত্র অভিভাবক হিসেবে মনে করে- এমন মন্তব্য করেছে অনলাইন ডেইলি মেইল। সর্বশেষ পাকিস্তানে বেসামরিক সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সংঘাত সৃষ্টি হয় সেই মেমোগেট নিয়ে। তা নিয়ে এখন তদন্ত চলছে। এ ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টে সেনাপ্রধান কিয়ানি ও সামরিক গোয়েন্দা প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ সুজা পাশা বিবৃতি দিয়েছেন। তার তীব্র সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, তারা এর মাধ্যমে সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। সব মিলে পাকিস্তান সঙ্কটে জড়িয়ে পড়ে সেনাবাহিনী, সুপ্রিম কোর্ট ও সরকার। তা আস্তে আস্তে জটিল থেকে জটিল আকার ধারণ করে। এখন সেখানে সরকার টেকানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আগামীকাল পার্লামেন্টে আস্থা ভোটের মুখোমুখি হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী গিলানি। গণতন্ত্রপন্থিরা বলে, পাকিস্তানের ইতিহাসে সামরিক অভ্যুত্থান ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় আদালতের হস্তক্ষেপের কারণেই দেশটি বারবার এমন সঙ্কটকালে উপনীত হচ্ছে। এমনিতেই দেশটি নানা জটিল সব সমস্যায় জর্জরিত। এর মধ্যে আছে অর্থনীতি ভেঙে পড়া। আল কায়েদা ও তালেবানপন্থিদের উত্থান। অভিযোগ আছে, দেশটির সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই নিজেই জঙ্গিদের সমর্থন দেয়। গত বছর সাংবাদিক সালিম শাহজাদকে হত্যা করা হয়। এ নিয়ে সরকার নিয়োজিত এক তদন্ত কমিশন তাদের তদন্ত প্রতিবেদন শুক্রবার জমা দিয়েছেন। তাতে তারা আইএসআই’কে আরও বেশি আইন মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছে। ওই সাংবাদিক তার বন্ধুদের বলেছিলেন- তাকে আইএসআই থেকে হুমকি দেয়া হচ্ছে। এ কথা প্রকাশ পাওয়ার পরই তাকে হত্যা করা হয়।
ওদিকে বিলম্বে পাওয়া খবরে জানা যায়, সামরিক অভ্যুত্থান আতঙ্কে প্রধানমন্ত্রী গিলানি বৃটিশ সহায়তা চাননি। এমন কথা বলা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। প্রধানমন্ত্রী হাউজ থেকে এক মুখপাত্র এ ধরনের খবর প্রত্যাখ্যান করেছেন।


No comments

Powered by Blogger.