জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়-জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের দায় কার? by রাশেদ মেহেদী

জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায় এড়ানোর পথ খুঁজছে। আসল হোতা আজগর বাহিনীকে শাস্তি না দিয়ে পুরো ঘটনাকেই আইওয়াশ করার চক্রান্ত করছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অপকীর্তির জবাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলছে।


জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সব সন্ত্রাসীকে শাস্তি দিয়ে ক্যাম্পাস থেকে সন্ত্রাস নির্মূলে সাধারণ শিক্ষার্থীরই আবারও ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে টানা পাঁচ বছর শিক্ষা জীবন কাটিয়ে এসেছি। নিজের চোখের সামনেই ১৯৯৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে আর একজন ছাত্র আনন্দ কুমার ঘোষ হত্যার বীভৎস ঘটনা দেখে এসেছি। ক্যাম্পাসে সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতায় আরও একটি বিষয় খুব নিবিড়ভাবে অনুভব করেছি, শিক্ষক রাজনীতির জটিল মারপ্যাঁচেই ছাত্ররাজনীতি কদর্য হয়ে ওঠে। টেন্ডারবাজি নিয়ে ছাত্রদের সংঘাতের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ, তার শিকড় শিক্ষক রাজনীতির নষ্টগর্ভে। বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর দায়িত্ব নেওয়ার পর ক্যাম্পাসে একের পর এক সন্ত্রাস, অসংখ্য শিক্ষার্থীর পঙ্গু হয়ে যাওয়া, শিক্ষা জীবন নষ্ট হয়ে যাওয়া, সর্বশেষ জুবায়ের হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত অনেক কিছুই ঘটেছে। এর দায় কার? নিয়ম অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু বর্তমান উপাচার্য অভিভাবক হিসেবে সফল হননি, বরং তার নিজের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী লালনের গুরুতর অভিযোগ আছে ছাত্রলীগের নিরীহ নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্র্থীদের।
২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বর্তমান উপাচার্য শরীফ এনামুল কবীর দায়িত্ব নেন। মনে আছে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার একদিন আগে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ তৎকালীন প্রক্টর অধ্যাপক নাসিরউদ্দিনের বাসায় হামলা করেছিল। সে সময় 'আদি ছাত্রলীগ' এবং 'জাতীয়তাবাদী ছাত্রলীগ' নামে দুটি গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল দফায় দফায়। ভয়াবহ অরাজকতার মধ্যে দায়িত্ব নিয়ে অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর খুব দ্রুত কয়েকজনকে বহিষ্কার করেন। সে সময় জাহাঙ্গীরনগরের টপ টেরর হিসেবে পরিচিত বন্দুক সুমনও গ্রেফতার হয়। এই গ্রেফতারের পর উপাচার্য সদর্পে বলেছিলেন, এ ক্যাম্পাসে কাউকে সন্ত্রাস করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু বাস্তবে সেই ঘোষণা আর থাকেনি। কারণ উপাচার্য নিজেই সন্ত্রাসের রাজনীতির চোরাবালির গডফাদারে পরিণত হন।
বিশেষ করে কয়েক মাস পর যখন রফিক-জব্বার হল এবং ড. ওয়াজেদ মিয়া গবেষণা কেন্দ্র নির্মাণের কোটি টাকার টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু হলো, তখন সন্ত্রাস আবার তীব্র আকার ধারণ করল। ছাত্রলীগের সেই জাতীয়তাবাদী গ্রুপ আর আদি গ্রুপে সংঘর্ষ বাধল। এই সংঘর্ষের ভয়াবহতার সাক্ষী হিসেবে আজও দাঁাড়িয়ে আছে আল বেরুনী হল। একজন ছাত্রকে মেরে রক্তাক্ত করে তারপর চারতলা থেকে ফেলে দেওয়া হয়। ছাত্রটি কাঁটাতারে ঝুলে থাকে বীভৎসভাবে। সে সময় উপাচার্য ক্যাম্পাস ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক শাফিন-শাম্মুসহ প্রায় ২০-২৫ জন ছাত্রলীগ কর্মীকে বহিষ্কার করেন। সে সময় উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তার নির্দেশেই ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ আরেকটি গ্রুপকে হটিয়ে দিতে গেলে সংঘর্ষ বাধে। তখন ছাত্রলীগেরই কিছু কর্মী সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছিলেন, তাদের কাছে উপাচার্যের সেই নির্দেশের রেকর্ড আছে। তিনি বলেছিলেন, 'ওদের মার দিয়া আমার কাছে আসবা, মার না দিয়া কোনো আবদার করবা না।' সে সময় আসলে কী ঘটেছিল তার তদন্ত করা যেতে পারে রফিক-জব্বার হল নির্মাণের সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের সাহায্য নিয়ে।
আল বেরুনী হলে ভয়াবহ সন্ত্রাসের সেই সময় উপাচার্য নিজের কাঁধে দায় তুলে নিয়েছিলেন ছাত্রলীগের একটি গ্রুপকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কার্যক্রম স্থগিত করলেও অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়ে ছাত্রলীগের সেই গ্রুপটি আজও ক্যাম্পাসে শক্তিমান। এমনকি জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এই গ্রুপের আজগর, শামীম ও শরীফের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে উপাচার্য কোনো ব্যবস্থাই নেননি। বরং জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের পর সাধারণ শিক্ষার্থীরা যখন উপাচার্যকে তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখে, তখন এই তিনজন এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গকে ডেকে নিজেকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করেছেন উপাচার্য। জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের জন্য তিনজনকে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ ভালো। কিন্তু মূল তিন হোতাকে বাদ দিয়ে তাদের সহযোগী তিনজনকে বহিষ্কার করার ঘটনা কি আইওয়াশ নয়? এই আইওয়াশের দায় কি উপাচার্য নেবেন না? এদের মধ্যে আজগরের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে শিক্ষককে অপমান এবং সাংবাদিক, সাংস্কৃতিককর্মী, প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের নির্যাতনের অসংখ্য অভিযোগ আছে। সবচেয়ে বড় কথা, এই আজগর ছাত্রদল থেকে ছাত্রলীগে এসেছে এবং এটি সবাই জানে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর কেন বারবার ছাত্রদল থেকে আসা আজগরের অপকর্মের দায় নিচ্ছেন, সেটা সবার কাছেই একটা বড় রহস্য। এর আগে সাগর নামে আরও এক ক্যাডার, যার বিরুদ্ধে বহু সন্ত্রাসের অভিযোগ ছিল তাকে নিজের অফিসে প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে উপাচার্য তার সন্ত্রাসের দায়ও নিয়েছেন। এগুলো উপাচার্যের প্রকাশ্য দায়। এরপরও তিনি বলবেন, জুবায়ের হত্যাকাণ্ডে তার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায় নেই?
জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায় এড়ানোর পথ খুঁজছে। আসল হোতা আজগর বাহিনীকে শাস্তি না দিয়ে পুরো ঘটনাকেই আইওয়াশ করার চক্রান্ত করছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অপকীর্তির জবাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলছে। জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সব সন্ত্রাসীকে শাস্তি দিয়ে ক্যাম্পাস থেকে সন্ত্রাস নির্মূলে সাধারণ শিক্ষার্থীরই আবারও ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখবে, এটাই তাদের অগ্রপথিক হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা।

রাশেদ মেহেদী : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র, সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.