দুজনের জবানবন্দি-ক্ষোভের বশে খুন করেন ছাত্রলীগের কর্মীরা by অরূপ রায় ও শামসুজ্জামান

ছর দুয়েক আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কর্মী আশিকুল ইসলাম ও রাশেদুল ইসলামকে হলের কক্ষে আটকে বেধড়ক পেটান একই ছাত্রসংগঠনের কর্মী জুবায়ের আহমেদ। ওই ঘটনার ক্ষোভে আশিক, রাশেদুল, মাহবুব আকরাম, নাজমুস সাকিবসহ ১০-১২ জন ছাত্রলীগের কর্মী ৮ জানুয়ারি জুবায়েরকে দফায় দফায় পাইপ দিয়ে মারধর করেন।


এ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে স্বীকারোক্তি-মূলক জবানবন্দি দিয়েছেন জুবায়ের হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্রলীগের কর্মী মাহবুব ও সাকিব। এর মধ্যে মাহবুব গত শুক্রবার ও সাকিব গত রোববার ঢাকা জেলার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতের জ্যেষ্ঠ হাকিম কাজী শহীদুল ইসলামের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
এদিকে, জুবায়ের হত্যা মামলার প্রধান আসামি ছাত্রলীগের কর্মী আশিকুলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গতকাল মঙ্গলবার চার দিনের রিমান্ডে নিয়েছে আশুলিয়া থানার পুলিশ। ঢাকা জেলার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে ১০ জানুয়ারি আশিককে চার দিনের রিমান্ডে নিয়েছিল পুলিশ।
ছাত্রলীগের কর্মী মাহবুব তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন, ৮ জানুয়ারি বিকেল সাড়ে চারটার দিকে পরীক্ষা দিয়ে হল থেকে বের হন। ঠিক তখনই প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ছাত্র বন্ধু জাহিদের ফোন পেয়ে তিনি (মাহবুব) ক্যাম্পাসের ভেতরে বিজ্ঞান কারখানার পেছনে গজারি বনে যান। সেখানে গিয়ে দেখতে পান, আশিক ও রাশেদ জুবায়েরকে জিআই পাইপ দিয়ে পেটাচ্ছেন। তিনি নিজেও জুবায়েরকে পাইপ দিয়ে আঘাত করেন। এভাবে দফায় দফায় জুবায়েরকে পেটানো হয়। সন্ধ্যার দিকে জঙ্গলের ভেতরে একটি রিকশা ডেকে এনে জুবায়েরকে মীর মশাররফ হোসেন হলের কাছে নেওয়া হয়। সেখান থেকে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে জুবায়েরকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান আশিক ও রাশেদ। পরের দিন তিনি (মাহবুব) জানতে পারেন, জুবায়ের মারা গেছেন।
মাহবুব তাঁর জবানবন্দিতে আরও বলেন, বছর দুয়েক আগে জুবায়ের রাজনৈতিক কারণে আশিক ও রাশেদুলকে পেটান। সেই ক্ষোভে আশিক, রাশেদুল, নাজমুস সাকিবসহ তাঁরা ১০-১২ জন বন্ধু জুবায়েরকে মারধর করেন।
একই রকম বক্তব্য দিয়ে জুবায়েরকে মারধর করার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন নাজমুস সাকিব।
জুবায়ের হত্যার ঘটনায় ৯ জানুয়ারি আশিক, রাশেদুল ও খান মো. রইসের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় ১০-১২ জনকে আসামি করে আশুলিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (নিরাপত্তা) মো. হামিদুর রহমান। পরদিন ওই তিন আসামিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়।
জুবায়ের হত্যার ঘটনায় প্রাথমিক তদন্ত শেষ করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শাহীন শাহ পারভেজ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জুবায়ের, আশিক ও রাশেদুল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে থাকতেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর জুবায়ের একবার আশিককে সারা দিন একটি কক্ষে আটকে মারধর করেন, আর রাশেদুলকে পিটিয়ে পা ভেঙে দেন। আশিক ও রাশেদুল তখন ওই হল থেকে চলে যেতে বাধ্য হন। এরপর আশিক থাকতেন মীর মশাররফ হোসেন হলে, আর রাশেদুল থাকতেন রফিক-জব্বার হলে।
এসআই শাহীন বলেন, ওই ঘটনায় জুবায়েরের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল আশিক ও রাশেদুলের। সেই ক্ষোভ থেকেই আশিক, রাশেদুল ও তাঁদের বন্ধুরা ৮ জানুয়ারি বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জুবায়েরকে পাইপ দিয়ে দফায় দফায় পেটান।
নতুন প্রক্টর তপন কুমার সাহা: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক তপন কুমার সাহাকে নতুন প্রক্টর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির দুই বছরের জন্য তপন কুমারকে প্রক্টরের দায়িত্ব দেন।
প্রক্টরের দায়িত্ব পাওয়ার আগে তপন কুমার গতকাল সকালে জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শ্যামল কুমার রায়কে ওই হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের হত্যার ঘটনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের মুখে প্রক্টর আরজু মিয়া পদত্যাগ করলে তপন কুমারকে নতুন প্রক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এদিকে, পাঁচ দফা দাবিতে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে ভাস্কর্যের পাদদেশ থেকে শিক্ষকসমাজের ব্যানারে মৌন মিছিল শুরু করেন আন্দোলনরত শিক্ষকেরা। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থান ঘুরে প্রশাসনিক ভবনের সামনে গিয়ে শেষ হয়। জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে শিক্ষকেরা ভবন চত্বরে ‘লাশ চিত্র’ অঙ্কন করেন।
দুপুর ১২টার দিকে নতুন কলা ভবনের সামনে থেকে ক্যাম্পাসে শোক মিছিল বের করেন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া বেলা তিনটার দিকে ক্যাম্পাসের পরিবহন চত্বরে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা অবিলম্বে সাবেক প্রক্টর আরজু মিয়াকে জুবায়ের হত্যার ঘটনার দায় স্বীকার করার দাবি জানান।
নতুন প্রক্টর তপন কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশা করছি, সম্মিলিত সহযোগিতার মধ্য দিয়ে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হবে।’

No comments

Powered by Blogger.