চালচিত্র-দেশ কোন পথে, জাতীয় ঐকমত্য জরুরি by শুভ রহমান

দেশের রাজনীতি এখন ঘটনাবহুল। সর্বশেষ ঘটনা মন্ত্রিসভায় তিনজন পূর্ণ মন্ত্রীর অন্তর্ভুক্তি। এর ঠিক আগে আগেই সিটিজেন ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড হিউম্যান রাইট্স বা সিডিএইচআর নামের এক নাগরিক সংগঠনের আত্মপ্রকাশ। আর কিছুকাল ধরে চলে আসছে টিপাইমুখ বাঁধ, তিস্তা চুক্তি, ঢাকা সিটি করপোরেশনের বিভাজন, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রশ্ন, যুদ্ধাপরাধের বিচার আর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফল আউট ও নরসিংদীর মেয়র


হত্যার জের। আর আছে শেয়ারবাজারে বারবার দরপতনজনিত বিক্ষোভ। এগুলো বড় ঘটনা এবং এসবকে কেন্দ্র করে অন্তত বিএনপি-জামায়াত ও তাদের সমর্থকরা মনে করছে, দেশ এখন অগি্নগর্ভ।এগুলো সাম্প্রতিক ঘটনাই। মহাজোট সরকারের মেয়াদের অর্ধেকেরও বেশি সময় চলে গেছে। মানুষ নানা প্রশ্নে যেমন ক্ষুব্ধ, তেমনি আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে, যেমন_উত্তরবঙ্গে মঙ্গা বিজয়, কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জন, লোডশেডিং হ্রাস, জাহাজ শিল্পের বিকাশ, ধীরগতি হলেও জাতীয় শিক্ষানীতির দৃঢ় বাস্তবায়ন, মানুষের সার্বিক ক্রয়ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি, জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি, বাজারে অনেক পণ্যেরই কিছুটা মূল্য হ্রাস, অনেক ক্ষেত্রেই জঙ্গিবাদ প্রায় নির্মূল হওয়া ও সন্ত্রাস তুলনামূলক অনেক হ্রাস পাওয়া, সড়ক দুর্ঘটনা তেমন হ্রাস না পেলেও সড়ক এবং যোগাযোগব্যবস্থার নৈরাজ্য ও দুর্ভোগ হ্রাস পাওয়া_এসব ঘটনা সাধারণ মানুষকে কিছু স্বস্তিও দিয়েছে। আবার বিদেশি বিনিয়োগ ও এর সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাওয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্বের বহু দেশে বাংলাদেশের প্রশংসিত ভূমিকা পালন_এ রকম আরো কিছু ইতিবাচক সাফল্য অর্জিত হওয়ায় শাসক মহাজোট ও দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলও হয়েছে। ফলে জোট আমলের দুঃশাসন মানুষ আর ফেরত আনতে চাইবে না।
তবে এটা ঠিক, দেশের মানুষের এক বিরাট অংশই আবার বিরোধী নেতা খালেদা জিয়ার রোডমার্চ ও জনসভাগুলোয় ব্যাপকভাবে জমায়েত হয়েও তাঁর সরকার পতনের ডাকে আপাতদৃষ্টিতে সাড়া দিয়ে যেন একটা চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
খালেদা জিয়া একেক সময় একেকটি প্রশ্নে তোলপাড় করছেন এবং সর্বশেষ ভারতের টিপাইমুখে বাঁধ দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরকারের প্রতি শক্ত অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, শক্ত অবস্থান নিতে ব্যর্থ হলে বর্তমান 'গণজাগরণ' 'গণবিপ্লবে' পরিণত করে তিনি সরকারের পতন ঘটানোর আন্দোলন গড়ে তুলবেন। সচেতন বিশ্লেষকদের মতে, ফ্লোটিং বা ভাসমান জনতার ওপর ভরসা করে ক্ষমতায় যাওয়ার আকাশকুসুম বস্তুত আহাম্মকিই! '৯০-এ ঢাকার বাইরে লক্ষাধিক মানুষের জনসমাবেশ করে এসেই সামরিক স্বৈরাচারকে তার পতন প্রত্যক্ষ করতে হয়েছিল। ভাসমান লাখো ও স্বতঃস্ফূর্ত মানুষের সমর্থন ক্ষমতার কোনো নিশ্চয়তা দেয় না। খালেদা জিয়া এখন ইতিহাস ভুলে ফ্লোটিং পিপলের ওপর ভরসা করেই সরকারের পতন ঘটানোর আকাশকুসুম কল্পনা করছেন।
এসবের বিপরীতে দেশের অনেক সচেতন মহলই বিরোধী নেতা ও তাঁর দল এবং সমমনাদের প্রতি তাদের সব কথা সংসদে গিয়ে বলার আহ্বান রাখছে। খোদ স্পিকারই বারবার তাদের সংসদে এসে সব দাবি জানাতে বলছেন, কিন্তু তাদের সংসদে ফেরার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। সারা দেশে রোডমার্চের পর রোডমার্চ করে খালেদা জিয়া যত বিশাল বিশাল জনসভাই করতে থাকুন না কেন, মানুষ তাঁদের যে উদ্দেশ্যে সংসদ সদস্য নির্বাচন করেছে, তার কোনো তোয়াক্কাই তিনি ও তাঁর রাজনৈতিক সহচররা করছেন না। এটা সচেতন দেশবাসী ভালোভাবেই লক্ষ করছে। এতে তাঁদের প্রতি মানুষের চূড়ান্ত আস্থা শেষ পর্যন্ত অটুট থাকবে কি না সন্দেহ। মানুষ অন্ধকারে কেন ঝাঁপ দেবে!
সিডিএইচআর বা 'তৃতীয় শক্তি'
এ দেশে তথাকথিত থার্ড ও ফোর্থ বা তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব বারবারই ঘটছে নানাভাবে, নানা ফর্মে। এটা যে প্রচলিত রাজনৈতিক শক্তিগুলোর আপাত ব্যর্থতার ফাটল দিয়েই গজিয়ে ওঠার সুযোগ পায়, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। এখনো সরকারের এবং বলা হচ্ছে বিরোধী দলেরও নানা ব্যর্থতার কারণেই উদ্যোক্তারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় এই নাগরিক কমিটি গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছেন। এটা নাকি হবে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটি সংগঠন, যা বিভিন্ন ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দলের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। তাঁদের ভাষায়, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র অর্জিত হয়নি। দেশের সাধারণ মানুষ ঘরপোড়া গরুর মতো সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায় বলেই বোধ হয় এই নাগরিক কমিটিকে, বিশেষ করে তাদের 'অরাজনৈতিক' হওয়ার দাবিতে বেশ শঙ্কিতই বোধ করছে। মানুষ সন্দেহ করছে, কোনো নেপথ্য শক্তি রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে এর পেছনে কাজ করছে কি না এবং এ দেশে আবার এর ভেতর দিয়ে কোনো ওয়ান-ইলেভেনের মতো তথাকথিত নির্দলীয়, অরাজনৈতিক অনাকাঙ্ক্ষিত শক্তির উদ্ভব ঘটে জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষাকে কার্যত নস্যাৎ করতেই দেশের রাজনীতি ও রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে নিজেদের ও বহিঃশক্তির সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধারেই মত্ত হয় কি না। সিন্দবাদের দৈত্যের মতো ওয়ান-ইলেভেনের বিপদকে দেশের বুকের ওপর থেকে নামানোর জন্য, বিশেষ করে বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও দেশের প্রধান দুই দলের নেতাসহ অনেক নেতা-কর্র্মীকেই কারা নির্যাতনসহ বিভিন্ন নিগ্রহ-নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে।
সচেতন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভূরাজনৈতিক স্বার্থ ও পরস্পর সংঘাতময় প্রভাববলয় সৃষ্টির প্রতিদ্বন্দ্বিতা এ দেশকে চিরতরে পদানত করে রাখার উদ্দেশ্যে নেপথ্য থেকে বারবারই এ দেশকে গণতন্ত্রের নামে বিরাজনৈতিকীকরণের অন্ধকার বিবরেই নিক্ষেপের চেষ্টা চলছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও রাজনৈতিক সচেতনতাই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করার দরুন শেষ পর্যন্ত তথাকথিত নির্দল ও অরাজনৈতিক শক্তির ষড়যন্ত্র ও আগ্রাসন প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে। তবে আবারও যে তার আত্মপ্রকাশ ঘটবে না, তা বলা যায় না।
বর্তমানে প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের নেতৃত্বে দেশের আপাতনিরপেক্ষ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং দেশ, গণতন্ত্র ও জনগণের কল্যাণকামী হওয়ার দাবিদার সাবেক রাজনীতিক, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী প্রমুখ যে নাগরিক কমিটি গড়েছেন, তা হয়তো সম্পূর্ণ সাধু ও মহৎ উদ্দেশ্যেই গঠিত হয়েছে। হয়তো এ কমিটির দেশের কল্যাণে ওয়াচডগের ভূমিকা পালনের মিশন রয়েছে। তবে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে ঠিক পথে আনার এটাই ইতিহাস নির্দিষ্ট ও বিজ্ঞানসম্মত গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি কি না, দেশের সচেতন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে এখনো সে ব্যাপারে যথেষ্ট সংশয় প্রকাশ করছেন। তা ছাড়া যাঁরা অনির্বাচিত এবং সেহেতু জনগণের প্রতি যাঁদের সত্যিকার কোনো দায়বদ্ধতা থাকবে না, নির্বাচিত গণতান্ত্রিক শক্তির ওপর চাপ প্রয়োগের বৈধতা ও নৈতিক অধিকার এবং ফলপ্রসূ কার্যকর ভূমিকা তাঁদের কতটা থাকবে, থাকা উচিত কি না_এ প্রশ্নও অত্যন্ত জোরদার এবং প্রাসঙ্গিক হয়েই বাজছে।
নেপথ্য কোনো শক্তি যদি তৃতীয় কোনো দল বা শক্তি খাড়া করে দেশের নির্বাচিত রাজনৈতিক শক্তির ওপর খবরদারি করতে যায়, তবে পরিণাম মধ্যপ্রাচ্যের অশান্ত পরিস্থিতির মতো কোনো পরিস্থিতি ডেকে আনবে কি না সচেতন মানুষ তা-ও না ভেবে পারছে না। আজকের একমেরুর বিশ্বে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকেও কি পরাশক্তির বিশ্ব স্ট্র্যাটেজির বলি হতে হয় কি না, তা সচেতন মহলকে ভাবিয়ে তুলছে। যাহোক, আমরা নতুন সিডিএইচআর বা নাগরিক উদ্যোগের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই, দেশের প্রকৃত হিতসাধনের মহৎ আকাঙ্ক্ষা থেকে তারা যা করতে চায়, তা বিদ্যমান নির্বাচিত রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে করলেই ভালো হয়। তাতে কোনো রকম ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকবে না এবং সাধারণ মানুষও বিভ্রান্ত হবে না।
জাতীয় ঐকমত্য গড়ার প্রস্তাব
আমরা কিছুকাল আগেই টিপাই বাঁধ, তিস্তা চুক্তিসহ দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নিয়ে দলমত-নির্বিশেষে সব পক্ষের একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠান ও জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলার প্রস্তাব রেখেছিলাম। সরকারি ও বিরোধী দলের পাল্টাপাল্টি অবস্থান, বিরোধী দলের গণজাগরণ, গণবিপ্লব ও সরকার পতনের হাঁকডাক এবং এর ভেতর দিয়ে পরিশেষে নাগরিক কমিটির মতো তৃতীয় দলের আবির্ভাব ঘটা_এসব জাতীয় ঐকমত্য থেকে দেশকে ক্রমেই দূরে ঠেলে দিতে চাইছে। ইতিমধ্যে শত নাগরিক কমিটির নামে একটা একপেশে গোলটেবিল বৈঠকে তথাকথিত জাতীয় ঐক্য গড়ে শাসক আওয়ামী লীগকে হটানোর আহ্বান জানানো হয়েছে, তা-ও বস্তুত জাতীয় সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য গড়ার পরিপন্থী মাত্র। আমরা আবারও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে দ্রুততম সময়ে সরকারি উদ্যোগে সব বিরোধীয় প্রশ্নে দলমত-নির্বিশেষে দেশের কল্যাণকামী সব শক্তির একটি আশু জাতীয় সম্মেলন বা গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্য সুপ্রতিষ্ঠিত করার আহ্বান রাখছি। ২৯.১১.২০১১

No comments

Powered by Blogger.