বিভাজিত সিটি করপোরেশন-নিশ্চিত করা হোক সেবা ও সমন্বয়

শেষ পর্যন্ত বিভক্ত হয়ে গেল ঢাকা সিটি করপোরেশন। নিন্দুকরা যে যা-ই বলুন না কেন, বিশ্বে একটা নজির সৃষ্টি করা গেল। পৃথিবীর কোথাও যা নেই, আমাদের তা আছে। বাংলাদেশের চেয়ে বড় অনেক দেশ পৃথিবীতে আছে। ঢাকার চেয়ে অনেক বড় শহর আছে। আছে ঢাকার চেয়ে উন্নত অনেক শহর। কিন্তু এখন থেকে একমাত্র আমরাই বলতে পারি, আমাদের রাজধানী শহরটি এতই বড় যে তা দুই সিটি করপোরেশনের আওতায়।


বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র দেশের রাজধানী শহরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব যে প্রতিষ্ঠানটির ওপর, সেই সিটি করপোরেশন ভেঙে দুই ভাগ করা হলো। ঢাকা সিটি করপোরেশনকে বিভক্ত করার ভেতর দিয়ে পরিচয় মিলেছে আমাদের দক্ষতা ও যোগ্যতার। ৪০০ বছর ধরে গড়ে ওঠা রাজধানী ঢাকা, পৌরসভা হিসেবে যার যাত্রা শুরু ১৪৭ বছর আগে, সেই ঢাকার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা সিটি করপোরেশন ভেঙে দুই ভাগ করতে নাকি পাঁচ মিনিটও সময় লাগেনি। বঙ্গভঙ্গ কেন হয়েছিল, তা নিয়ে ইতিহাসে অনেক লেখালেখি হয়েছে। ঢাকা সিটি করপোরেশন কেন ভেঙে ফেলা হলো, তার প্রকৃত ইতিহাসও হয়তো একদিন জানা যাবে। আপাতত স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর বাণীই আমাদের কাছে প্রণিধানযোগ্য। তিনি দাবি করে বলেছেন, ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভাজনের পেছনে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। মহানগরীর উন্নয়নের স্বার্থেই কাজটি করা হয়েছে। সরকারের বক্তব্য সেটাই। রাজধানীবাসীর সেবা নিশ্চিত করতেই ভেঙে ফেলা হয়েছে ঢাকা সিটি করপোরেশন। আসা যাক তবে মহানগরীর উন্নয়ন ও সেবা বিষয়ে। একেকজনের কাছে উন্নয়নের সংজ্ঞা একেক রকম। তবে উন্নতি সবাই চান। সেবা পাওয়ার অধিকারও সবার আছে। সেবা দেওয়ার কথা যাদের, সেই সংস্থাগুলো সেবা প্রদানের ব্যাপারে কতটুকু আন্তরিক, সেটাই মুখ্য প্রশ্ন। পাশাপাশি বিবেচনার বিষয় সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সেবা প্রদানের সক্ষমতার দিকটি। এসব বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে প্রথমে। যদি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাগুলোর সেবা প্রদানের ব্যাপারে আন্তরিকতার অভাব থাকে, সে অভাব পূরণ করার দায়িত্ব কার? যদি সংস্থাগুলোর সক্ষমতার অভাব থাকে, সে অভাব পূরণের দায়িত্ব কার? আর যদি একটা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কাজের সমন্বয়ের অভাব থাকে, তাহলে সেটা যে দুই সিটি করপোরেশন হলে আরো বাড়বে, তা বোধ হয় বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। সিটি করপোরেশনের ১০টি আঞ্চলিক অফিসকে যারা সক্রিয় করতে ব্যর্থ, দুই সিটি করপোরেশন পরিচালনায় তাদের সাফল্য নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।
ঢাকার আয়তন এখন ৫৫০ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা এক কোটি ২০ লাখ। ভোটার ৪০ লাখ। ২৮টি থানা। ৯২টি ওয়ার্ডের দুই হাজার ৩০০ কিলোমিটার রাস্তায় জ্বলে ২১ হাজার বাতি।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের সমস্যা অনেক। অসময়ে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি হয়। রাস্তাঘাট ভাঙা। যদিও বর্তমান মেয়র দাবি করেছেন, মহানগরীর অধিকাংশ রাস্তার অবস্থা ভালো। গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয় রাজধানীবাসীকে। রাস্তায় বের হলেই যানজট খেয়ে ফেলে দিনের অনেকটা শ্রমঘণ্টা। এ সমস্যাগুলো থেকে মুক্তি পেতে চায় রাজধানীবাসী। উন্নয়নের স্বার্থে যে সিটি করপোরেশনকে ভাগ করা হলো, সেই সিটি করপোরেশনে এখন কী আশা করা যায়? ঢাকার রাস্তা থেকে কী মন্ত্রবলে যানজট উধাও হয়ে যাবে, থাকবে না বিদ্যুৎ বিভ্রাট? নগরবাসী এখন কি এমনটি আশা করতে পারবে। আশা করতে পারবে ঘরে ঘরে নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে এখন আর বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হবে না? পানির অভাবে থাকতে হবে না। ভাড়া বাসায় যাদের বসবাস, তাদের নিশ্চয়ই থাকতে হবে না অতিরিক্ত বাড়ি ভাড়ার চাপে?
ঢাকাকে বিভক্ত করার আগে বিশেষজ্ঞদের মত নেওয়া হয়নি। ঢাকাবাসীর অভিমত বোধ হয় উপেক্ষিতই। আবেগের মূল্য জোটেনি। তবে একটু আন্তরিক হলে বোধ হয় সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সুসমন্বয় ঘটিয়ে ঢাকাবাসীকে আরেকটু সুখে রাখা যেত। যে জনদুর্ভোগের চিন্তা এখন করা হচ্ছে, সেটা অন্তত থাকত না। এখন বিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের উত্তর ও দক্ষিণ বলয়ে সেবা ও সমন্বয় নিশ্চিত করার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা সে দায়িত্ব পালন করলেই নিশ্চিন্ত।

No comments

Powered by Blogger.