সংবাদ সম্মেলনে সন্তু লারমা-শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে মার্চে মহাসমাবেশ

পার্বত্য শান্তিচুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনাসহ (রোডম্যাপ) ১৯ দফা দাবি আদায়ে জনসংহতি সমিতি আগামী মার্চে মহাসমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।গতকাল বুধবার সকালে ঢাকার একটি হোটেলে আয়োজিত জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, চুক্তি বাস্তবায়ন না করে সরকার


বিশ্বাসঘাতকতা করছে।আগামীকাল ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তির ১৪তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এ সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে জনসংহতি সমিতি এই প্রথম মহাসমাবেশের মতো বড় কর্মসূচি ঘোষণা করল।
সন্তু লারমা বলেন, 'শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার বিশ্বাসঘাতকতা করে চলেছে। পার্বত্য সমস্যা সমাধানের জন্য চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। কোনো সরকারই চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক নয়। আমরা সরকারের সঙ্গে বরাবরই যোগাযোগ রক্ষা করে এসেছি। কিন্তু গত ১৪ বছরেও তাদের মধ্যে এ জন্য কোনো তাগিদ দেখিনি।'
তিনি বলেন, "একদিকে সরকারের মন্ত্রী-আমলারা সভা-সমিতিতে চুক্তি বাস্তবায়নের সদিচ্ছার বুলি আওড়ে চলেছেন, অন্যদিকে কতিপয় মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী চুক্তি বাস্তবায়ন সম্পর্কে নানা বিভ্রান্তিকর, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের ব্যর্থতাকে ধামাচাপা দিতে তারা 'চুক্তি বাস্তবায়ন দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার, চুক্তি বাস্তবায়নে জনসংহতি সমিতি সহযোগিতা করছে না, পাহাড়ি নেতারা এ অঞ্চলের উন্নয়ন চায় না' ইত্যাদি মনগড়া ও উদ্ভট বক্তব্য দিচ্ছে।"
আগামী মার্চে মহাসমাবেশ ছাড়া ঘোষিত অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শান্তিচুক্তির ১৪তম বর্ষপূর্তির দিনে আগামী শুক্রবার সকালে চট্টগ্রাম ও তিন পার্বত্য জেলায় এবং বিকেলে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গণসমাবেশ, আগামী জানুয়ারি থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণসংযোগ, গণসমাবেশ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন এবং জনসংহতি সমিতির সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করা।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জনসংহতি সমিতির তথ্য সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমা, সাংগঠনিক সম্পাদক শক্তিপদ ত্রিপুরা, আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, পাহাড়ি নেতা বিজয় কেতন চাকমা, নাগরিক আন্দোলনের সৈয়দ আবুল মকসুদ ও গণফোরামের পঙ্কজ ভট্টাচার্য।
সাবেক গেরিলা নেতা সন্তু লারমা পার্বত্য পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বলেন, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পাহাড়ের মৌলিক কোনো অগ্রগতি হয়নি। চুক্তি-পূর্ব অবস্থার মতো এখনো সেখানে সর্বক্ষেত্রে সেনা-কর্তৃত্ব বজায় রয়েছে। জুম্ম (পাহাড়ি) জনগণের ওপর রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্যাতন-নিপীড়ন এখনো আগের মতোই অব্যাহত রয়েছে। 'অপারেশন উত্তরণ'-এর ছত্রছায়ায় এবং প্রশাসনের সহায়তায় উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ও সেটেলার বাঙালিরা জুম্মদের জায়গা-জমি জবরদখল করার জন্য তাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। সেনানিবাস সম্প্রসারণ, ইকোপার্ক ও পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন, উন্নয়নের নামে অস্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছে ভূমির ইজারা প্রদান, সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা প্রভৃতির নামে জায়গা-জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে জুম্মদের উচ্ছেদের প্রক্রিয়া জোরদার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ঘরবাড়িতে অগি্নসংযোগ ও লুটপাট, নিরীহ গ্রামবাসীদের ওপর হামলা ও তাদের হত্যা, জুম্ম নারীদের অপহরণ, ধর্ষণ প্রভৃতি সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাধ্যমে জুম্মদের জাতিগতভাবে নির্মূল করার প্রক্রিয়া চলছে। চুক্তিবিরোধী ইউপিডিএফের সন্ত্রাসীদের অবাধে চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে পাহাড়ে এক ভীতিকর পরিস্থিতি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ইউপিডিএফ ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে কোনো ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত নেই_ স্পষ্ট এ কথা জানিয়ে সন্তু লারমা বলেন, '১৯৯৬ সালের সরকারের একটি বিশেষ মহল ইউপিডিএফ নামের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছে। তাদের লক্ষ্য শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করা এবং জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বকে ধ্বংস করা। তাদের হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে সাধারণ জনতারই একটি অংশ সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। আমরা বরাবরই ইউপিডিএফকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু ওই বিশেষ স্বার্থান্বেষী মহলটি পার্বত্য পরিস্থিতি অশান্ত রাখতে চায় বলেই ইউপিডিএফকে টিকিয়ে রেখেছে।'
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগামী ৪ ডিসেম্বর ইউএনডিপির অর্থায়নে সরকারি উদ্যোগে 'সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উৎসব' অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এতে 'আদিবাসী' অভিধার বদলে 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী' অভিধা ব্যবহার করা হয়েছে বলে দেশের আদিবাসী-অধ্যুষিত অঞ্চলে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে উত্থাপিত বিভিন্ন দাবির মধ্যে রয়েছে পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ আইন যথাযথভাবে কার্যকর ও এ-সংক্রান্ত কার্যবিধি চূড়ান্ত করা; তিন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান-সদস্যদের নির্বাচন বিধিমালা ও ভোটার তালিকা প্রণয়ন; আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান; পাহাড়ের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা (স্থানীয় পুলিশ), ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা ও মাধ্যমিক শিক্ষা, বন ও পরিবেশ, যুব উন্নয়ন, স্থানীয় পর্যটনসহ অ-হস্তান্তরিত সব বিষয় নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট পরিষদগুলোর কাছে হস্তান্তর; আঞ্চলিক পরিষদের সুপারিশ অনুযায়ী প্রস্তাবিত 'পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন, ২০১১' বিল অপরিবর্তিতভাবে পাস করা; পার্বত্য ভূমি কমিশন চেয়ারম্যান খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীকে অপসারণ করে একজন উপযুক্ত অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে নিয়োগ দেওয়া প্রভৃতি।

No comments

Powered by Blogger.