এ দেশে আবার আসব by জনি হক

র্মিলা ঠাকুর ঢাকায় এসেছিলেন দু'দিনের জন্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিজীবন এবং উল্লেখযোগ্য সাহিত্য রচনার অন্তরালের গল্প নিয়ে নির্মিত 'লাইফ আনএন্ডিং' শ্রুতিনাটকে অভিনয় করতে। হোটেল র‌্যাডিসনে অপেক্ষা করছি সাইফ আলী খানের মায়ের জন্য। অবশেষে এলেন তিনি। পরনে জিন্স-ফতুয়া। ৬৪ বছর বয়সের রেখা হয়তো মুখে আছে, কিন্তু চোখজুড়ে অফুরন্ত তারুণ্য। হাতে মুঠোফোন। দেখেই প্রথমে জানালাম, সত্যজিৎ রায়ের 'অপুর সংসার'


ছবির অপর্ণার মতোই তাকে আজও দেখি আমরা। তার মধ্যে আজও সেই ১৪ বছরের কিশোরীর ছায়া। তিনি একজন বাঙালি, বাংলা ছবির [অপুর সংসার] মাধ্যমেই তার অভিনয় জীবন শুরু। আবার বলিউডও জয় করেছেন, সে সময় রাজেশ খান্না, সঞ্জীব কুমার, শাম্মী কাপুর ও ধর্মেন্দ্রর সঙ্গে অভিনয় করেছেন। নিজের স্বতন্ত্র ঢঙও ছিল। এখনও তিনি কিছু করলে খবরের শিরোনাম হন। র‌্যাম্পে তরুণীদের সঙ্গে ক্যাটওয়াক করেন। এই যে এখনও তার মধ্যে কিশোরী বা তরুণী মনের ছায়া, এটা কীভাবে? 'জানি না! এর জন্য একটু নিয়ম মেনে জীবনযাপন করা, হাঁটাচলায় ব্যায়াম_ সবই করা হয়। আমাদের বয়সী যারা আগে কখনও ব্যায়াম করেননি তাদের হয়তো একটু সমস্যা হয়। হয়তো বার্ধক্যে পেঁৗছালে তাদের পায়ে ব্যথা করে। আমার তেমন সমস্যা নেই।
'অ্যান ইভেনিং ইন প্যারিস'-এর পর্দা কাঁপানো শর্মিলা ঠাকুরের চেয়ে বাঙালি হিসেবেই তাকে আমাদের বেশি ভালো লাগে। বাঙালি বলেই হয়তো এমন! এই আকর্ষণীয় নারীর পরিবারের একেকজন সদস্যও একেকটি তারা। স্বামী প্রয়াত মনসুর আলী খান পতৌদি ছিলেন টাইগার। ছেলে সাইফ আলী খান আর মেয়ে সোহা আলী খান বলিউডের প্রথম সারির নক্ষত্র। আরেক মেয়ে আছে সাবা আলী খান।
ফ্রান্সের কমান্ডার অব দ্য অর্ডার অব আর্টস অ্যান্ড লেটারস সম্মান, ভারতের জাতীয় পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, আজীবন সম্মাননা_ সবই পেয়েছেন। দূর থেকে দেখে শুরুতে চিন্তা হয়েছিল, নবাব পরিবারের বধূ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তারকা_ সব মিলিয়ে বেশ রক্ষণশীলই হবেন তিনি। কিন্তু কথা বলে মনে হলো, আর দশজন বাঙালি নারীর মতোই তিনি অতিথিপরায়ণ, মিশুক। আগে থেকেই জানি, শর্মিলা ঠাকুর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মীয়। তার নানি লতিকা ঠাকুর কবিগুরুর ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতনি। কবিগুরুকে নিয়ে জানতে চাওয়ার পর ছোটবেলার একটি স্মৃতি মেলে ধরলেন শর্মিলা। জানালেন, "রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার মাকে স্বাক্ষরসহ 'গোরা' উপন্যাসটি দিয়েছিলেন। এটা মায়ের কাছেই ছিল। আমি ওটা একবার নিয়ে গিয়েছিলাম স্কুলে। কিন্তু স্কুলে সেটা হারিয়ে ফেলি [হাসি]। এ কারণে মা খুব রাগ করেছিলেন। বুঝতেই পারছেন মায়ের খুব কাছের ছিল ওটা।"
হিন্দি ছবিতে শর্মিলা ঠাকুরকে যারা দেখে অভ্যস্ত তাদের একটা তথ্য দিয়ে রাখি, তিনি চমৎকার বাংলা বলেন। যদিও জন্ম ভারদের হায়দরাবাদে [১৯৪৬]। পড়াশোনা সেন্ট জন'স ডিওসিজান গার্লস উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ১৪ বছর বয়সে সত্যজিৎ রায়ের 'অপুর সংসার' ছবিতে প্রথম আবির্ভূত হলেন। কিন্তু অভিনয়ের কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই। ওই ছবির প্রথম দৃশ্যের কথা মনে আছে? "প্রথম ছবি, প্রথম দৃশ্য; মনে থাকবে না? অপু ও অপর্ণার মাত্রই বিয়ে হয়েছে। অপর্ণাকে নতুন বাড়িতে নিয়ে এসেছে অপু। আমি আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় আছি মানিকদার [সত্যজিৎ রায়] 'অ্যাকশন' শোনার জন্য। দরজা বন্ধ ছিল। ক্যামেরা ছিল দরজার পেছনে। সৌমিত্র জানতে চাইলেন, 'তোমার নার্ভাস লাগছে?' আমি বললাম_ না। তারপর মানিকদা 'অ্যাকশন' বলতেই সৌমিত্র দরজা খুলে আমাকে বললেন, 'এসো।' আমি ঘুরে ঢুকে চারপাশে তাকালাম। মানিকদা বললেন, 'কাট। চমৎকার। পরের দৃশ্যে যাওয়া যাক।"
আপনি একবার বলেছিলেন_ 'শুধু গ্গ্নামার নয়, ভালো অভিনয় জানতে হবে।' যারা নতুন তাদের মধ্যে এই বোধটা আছে বলে মনে হয়? 'এই বোধ সবারই আছে। আবার সময়ের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। ছবি বা অভিনয় আগের দর্শকের যেমন পছন্দ করার বিষয় আছে, তেমনি নতুনদের এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। সবারই একটা লক্ষ্য থাকা উচিত। আমাদের উপমহাদেশে একটা ব্যাপার আছে, বয়স হয়ে গেলেই সমস্যা। অভিনেতাদের তুলনায় অভিনেত্রীদের বেলায় এই সমস্যা বেশি হয়। বিশেষ করে অভিনেত্রীর বয়স ৩০-এর কোঠা পেরুলেই দর্শক গ্রহণ করতে চান না। সেজন্য বয়সের একটা সীমাবদ্ধতা থেকে যায়। তবে হলিউডের অনেকেই বয়সকে হার মানিয়ে অভিনয় করে যাচ্ছেন।'
হিন্দি বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষার ছবি 'লাইফ গোজ অন'-এ অভিনয় করেছেন শর্মিলা ঠাকুর। মারাঠি ভাষার একটি ছবিতেও কাজ করেছেন বয়স্ক চরিত্রে। 'বয়সী নারী হলেও এর খারাপ কোনো প্রভাব পড়েনি।'
'অ্যান ইভেনিং ইন প্যারিস' কি আপনার অন্যরকম ভাবমূর্তি তৈরি করেছিল? "সে সময় অন্য অভিনেত্রীদের চেয়ে আলাদা ছিলাম। তখন সবাই শাড়ি পরত আর আমি পরছিলাম জিন্স। তবে 'আরাধনা'র পর আমার ভাবমূর্তি পাল্টালো। এখন আমি ক্যারিয়ারের শেষ অধ্যায়ে আছি। তবে সবকিছু নিয়ে আমি খুশি।"
বলিউডে 'কাশ্মির কি কলি', 'আরাধনা', 'অমর প্রেম', 'চুপকে চুপকে', বাংলায় সত্যজিৎ রায়ের 'অপুর সংসার' [১৯৫৯], 'দেবী' [১৯৬০], 'নায়ক' [১৯৬৬], 'অরণ্যের দিনরাত্রি' [১৯৭০] ও 'সীমাবদ্ধ' [১৯৭১], তপন সিনহার 'নির্জন সৈকতে' [১৯৬৩], 'শেষ অঙ্ক' [১৯৬৩], 'ছায়া সূর্য' [১৯৬৩], 'বর্ণালী' [১৯৬৩], 'প্রভাতের রঙ' [১৯৬৪], 'প্রতিদান' [১৯৮৩], 'অনুরোধ' [১৯৮৭] পর্যন্ত শর্মিলাকে নিয়মিতই পাওয়া গেছে। এরপর শুধু হিন্দি ছবিতেই কাজ করছিলেন। ১৬ বছর বিরতি দিয়ে ফিরে এলেন বাংলায়। কাজ করলেন ঋতুপর্ণ ঘোষের 'শুভ মহরত' [২০০৩] আর গৌতম ঘোষের 'আবার অরণ্যে' [২০০৩] ছবিতে। এর ছয় বছর পর তাকে দেখা গেছে অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরীর 'অন্তহীন' [২০০৯] ছবিতে। "টনি [অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী] খুব ভালো কাজ করছে। 'অন্তহীন' ছবির সব দৃশ্যে আমাকে শাড়ি আর চোখে চশমা পরে থাকতে হয়েছে। এ ধরনের চরিত্র হিন্দি ছবিতে সাধারণত পাওয়া যায় না। বাংলা ছবি ভাবায়, কিন্তু হিন্দি ছবি তা পারে না।"
এখন ছবি করা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছেন শর্মিলা ঠাকুর। সর্বশেষ 'ব্রেক কি বাদ' ছবিতে দেখেছি তাকে। জানালেন, 'আমি এখন খুব একটা ছবি করছি না।'
যদি বাংলাদেশি ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়, করবেন? "হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আমি তো অভিনয় করতেই চাই। আপনাদের ববিতার 'অশনি সংকেত' দেখেছি।"
আপনার স্বামী মনসুর আলী খান পতৌদি তার দিক থেকে কিংবদন্তি ছিলেন। আমরা জানি, তিনি কখনও আপনার শৈল্পিক সত্তাকে বাধা দেননি। তাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? 'দেখুন, তার আর আমার জীবনের সবকিছুই আপনাদের জানা। এ নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই।'
শুনেছি শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে রান্না করা আর বাজার করা শিখেছেন। এসব কি এখনও করেন? 'হ্যাঁ, এখনও পরিবারের জন্য রান্না করি। এসব কাজ করতে আমার ভালো লাগে।'
এ দেশের পাঠক জানতে চায়_ আপনার ছেলে সাইফ আলী খান আর কারিনা কাপুরের সম্পর্ক। এ নিয়ে কিছু জানতে পারি? কারিনা কি আপনার ছেলের বউ হবে? 'এটা খুবই ব্যক্তিগত বিষয়। এ ব্যাপারে কথা বলতে চাই না।'
ছেলের সঙ্গে দিনে কতবার কথা হয়? 'সকাল, দুপুর, বিকেল, রাতে। বলতে পারেন সুযোগ পেলেই আমাকে ফোন করে ও।'
আপনি সাইফকে আগামীতে কোন জায়গায় দেখতে চান? "মা হিসেবে আমি মনে করি, সাইফ একজন ভালো মানুষ। ও নিজের সন্তানদের খুব যত্ন নেয়। আমি চাই, গোটা চলচ্চিত্র শিল্পে সাইফের অন্যরকম একটা ভাবমূর্তি থাকুক। এটা ঠিক, সোহার চেয়ে সাইফের গ্রহণযোগ্যতা বেশি এখন। অভিনেতা হিসেবে নিজেকে বৈচিত্র্যময় প্রমাণ করতে পেরেছে ও। সাইফ এখন অনেক পরিণত একজন অভিনয়শিল্পী। আমার কাছে ওর 'দিল চাহতা হ্যায়', 'ওমাকারা', 'বিইং সাইরাস', 'লাভ আজকাল' বেশি ভালো লাগে।"
আগামী ৮ ডিসেম্বর শর্মিলা ঠাকুরের জন্মদিন। সেদিন ৬৫ বছরে পড়বেন তিনি। ব্যক্তিজীবনে বালিকা বিবাহ প্রতিরোধে ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে কাজ করছেন। এসব তথ্য দিয়ে 'নমস্কার' বললেন। তাকে ধন্যবাদ জানালাম। তিনি হাসিমুখে ভ্যানিটি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে চলে গেলেন। তবে হেঁটে যেতে যেতে বললেন, 'এ দেশে আবার আসব।'

No comments

Powered by Blogger.