দুর্ঘটনা-সড়ক দুর্ঘটনা ও রাষ্ট্রের বিচার by আবির হাসান

যেসব ড্রাইভার-চালক জীবনে একটিও দুর্ঘটনা ঘটাননি তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করতে পারি অথবা প্রতি জেলায় এ রকম শ্রমিকদের তালিকা প্রচারমাধ্যমে প্রকাশ করে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশেষ বোনাসের মাধ্যমে সম্মানিত করা যায়। এর ফলে তারা নিজেদের সম্মানিতবোধ করতেন ও সচেতনতা তৈরি হতোতেরো আগস্ট মারা গেলেন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ, শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর পুত্র মিশুক মুনীর, গাড়িচালক মোস্তাফিজুর রহমানসহ পাঁচজন। তারেক


মাসুদ ও মিশুক মুনীর নিজ যোগ্যতায় যে গুরুত্ব অর্জন করেছেন, সেই গুরুত্বের চাপে বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাই প্রশ্নের মুখে পড়েছে, নড়েচড়ে বসেছে সরকারও। কিন্তু কারও লেখাতেই গাড়িচালক মোস্তাফিজুর রহমান ও জমির হোসেনের দিকটি বিবেচিত হয়নি। শুনেছি রামের হনুমানও দেবতা। তাহলে গাড়িচালক মোস্তাফিজুর রহমানের লাশ অন্যদের সঙ্গে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য রাখা হলো না কেন? বিপ্লবী কবি মায়াকোভস্কির লাইন ক'টি খুবই প্রাসঙ্গিক_ 'সাত তোরণের থিবস নগরী গড়েছে কারা?/ইতিহাসে শুধু রাজাদেরই নাম পাবে।/পাথর কখনো রাজারা বয়েছে কাঁধে?'
একটি রাষ্ট্রের সড়ক-নৌ-রেল-বিমানসহ সব স্থাপনা কেমন হবে, তা নির্ভর করে রাষ্ট্রের চরিত্রের ওপর। রাষ্ট্রের কর্তৃত্বে কারা আসীন, তার ওপর। তাহলে আমাদের রাষ্ট্রের সড়ক-মহাসড়কগুলোর যে এত বাঁক, তার জন্যও শাসকশ্রেণীই দায়ী। প্রভাবশালীদের জমিজমা রক্ষা করতে গিয়েই ঠিকাদার-ইঞ্জিনিয়াররা রাস্তা ঘুরিয়ে দেন, গরিবের ওপর দিয়ে চলে যায় সড়ক-মহাসড়ক। ফলে সৃষ্টি হয় দুর্ঘটনার স্পট 'বাঁক'।
অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. শামসুল হক সড়ক দুর্ঘটনার জন্য যে তিনটি বিষয়কে প্রধান কারণ বলেছেন, সেগুলো হচ্ছে সড়কের বিন্যাস, পরিকল্পনা ও পরিবেশ। এই তিনটি বিষয়ই ঠিক করেন রাষ্ট্রের পরিচালক শ্রেণী। ঢাকা-আরিচা সড়ক যখন পাকিস্তান আমলে তৈরি করা হয়, তখন সেই সময়ের রাজনীতিবিদরা তাদের বাড়ির কাছ দিয়ে রাস্তা নিয়ে যাওয়ার কারণে বিশাল একটি বাঁক তৈরি হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় হয়েছে পেট্রোল ও শ্রমঘণ্টা বাবদ।
রাস্তার বেহাল দশা ও অজস্র অ্যাকসিডেন্টওয়ালা সড়কে যানজট বাদ দিয়ে ১০-১২ ঘণ্টা একজন মানুষ একটানা গাড়ি চালালে তার মাথার পরিস্থিতি কেমন হতে পারে, তা অনেকেই কল্পনা করতে পারে। সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ ড্রাইভারদের প্রতি আহ্বানে বলেছে, 'একটানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাবেন না।' এটা করা গেলে ড্রাইভার, কন্ট্রাক্টর বা সুপারভাইজার, হেলাপারকে মানুষ মনে না করা মধ্যবিত্ত আচরণের অংশ হয়ে উঠেছে। কোন অধিকারে শ্রমিকদের গালি দেওয়া হয়? রাষ্ট্র কি তাদের নৈতিক শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা চালু রেখেছে। বাংলাদেশে তো কত ধরনের পদকের ছড়াছড়ি। যেসব ড্রাইভার-চালক জীবনে একটিও দুর্ঘটনা ঘটাননি তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করতে পারি অথবা প্রতি জেলায় এ রকম শ্রমিকদের তালিকা প্রচারমাধ্যমে প্রকাশ করে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশেষ বোনাসের মাধ্যমে সম্মানিত করা যায়। এর ফলে তারা নিজেদের সম্মানিতবোধ করতেন ও সচেতনতা তৈরি হতো।
কেউ কেউ আবার শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাপটের কথা বলছেন। পত্রিকাগুলোতে রিপোর্ট আসছে, শ্রমিক সংগঠনের বাধার কারণে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ড্রাইভারদের ফাঁসি দেওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো শ্রমিক সংগঠনগুলো অত্যন্ত দুর্বল। সংগঠন শক্তিশালী হলে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ত, জীবনমানের অবস্থা উন্নত হতো, রাস্তাঘাট ঠিক হতো, নৌ ও রেলপথ প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম হতো। আর যা হতো না তাহলো, আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতারা নেতৃত্ব দখল করতে পারত না, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চেহারা এ রকম হতো না, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ পাচারের চক্রান্ত করার সাহস পেত না, বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ত না এবং আজকের আলোচ্য বিষয় দুর্ঘটনা, সেই দুর্ঘটনাও হতো না।
এত কিছুর পরও ড্রাইভারদেরই ঘাতক বলা হয়। যারা নিজ জমি রক্ষায় রাস্তায় বাঁক তৈরি করেছে তারা নয়; যে ইঞ্জিনিয়ার-ঠিকাদার চুরি করে রাস্তা খারাপ করেছেন তারা নয়; যাদের কারণে একজন ড্রাইভারকে একটানা ১০-১২ ঘণ্টা চালাতে হয় তারাও নয়; যে পরিকল্পনাকারীদের কারণে সড়ক ব্যবস্থার এই হাল তারাও নয়; শুধু ড্রাইভারই ঘাতক। অর্থাৎ যারা ফাঁদ বসাবে তারা ঘাতক নয়; যারা ফাঁদের পা দেবে তারাই ঘাতক। মিডিয়া আমাদের মতামত তৈরি করে দিয়েছে_ ড্রাইভারই ঘাতক।
কিন্তু প্রতি বছর যারা স্পেকট্রামের মতো ভবন ধসিয়ে নাম না জানা শত শত শ্রমিককে হত্যা করে, মেইন গেট লাগিয়ে শ্রমিক পোড়েন, সেসব গার্মেন্ট মালিকরা ঘাতক নন; ত্রুটিপূর্ণ লঞ্চ ডুবিয়ে এক ক্ষেপে ৪০০-৫০০ মানুষ মারেন, এসব মালিকও ঘাতক নন। তাদের মৃত্যুদণ্ডের দাবি কোথাও ওঠে না! কারণ রাষ্ট্রের পরিচালক তারাই, পত্রিকা-চ্যানেলের মালিকও। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, 'আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে-/তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।'

আবির হাসান :কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.