বদলে যাওয়া মিয়ানমারকে নিয়ে 'দড়ি টানাটানি'

সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারে বেশ কয়েকটি কূটনৈতিক সফর ঘিরে চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। তবে হিলারির মতো এত মনোযোগ কোনো সফরকারীর ভাগ্যে এখনো জোটেনি। অর্ধ শতকের বেশি সময়ে মার্কিন কোনো উচ্চপদস্থ সরকারি প্রতিনিধির এটিই প্রথম মিয়ানমার সফর। শেষবার ১৯৫৫ সালে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন ফস্টার ডালেস মিয়ানমার সফর করেছিলেন।


১৯৬২ সালে মিয়ানমারের শাসনভার চলে যায় সেনাবাহিনীর হাতে। তারপর টানা প্রায় পাঁচ দশক দেশ চালায় সামরিক জান্তা। দীর্ঘ এ সময়ে কার্যত বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে মিয়ানমার। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো অবরোধ আরোপ করে দেশটির ওপর। তবে গত বছর নির্বাচনের মাধ্যমে 'উর্দি আশ্রিত' গণতান্ত্রিক সরকারের যাত্রা শুরু হয় মিয়ানমারে। বিতর্কিত এ নির্বাচনে দেশটির গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী ও শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চির অংশগ্রহণ করতে না পারাকে ভালো চোখে দেখেনি পশ্চিমারা। তবে বেসামরিক ব্যবস্থায় উত্তরণের লক্ষ্যে বর্তমানের সরকারের কর্মসূচি পশ্চিমাদের 'বাহবা' কুড়াতে সক্ষম হয়। তারই অংশ হিসেবে গত ১৮ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নিজে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে হিলারির মিয়ানমার সফরের ঘোষণা দেন। তবে এর আগে সু চির সঙ্গে আলোচনা করেন ওবামা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হিলারির এ সফরের উদ্দেশ্য কেবল গণতন্ত্রের পথে জান্তা সমর্থিত সরকারের সংস্কারের হালহকিকত খতিয়ে দেখা নয়, পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের লড়াইকেও বেগবান করা। চীনের দোরগোড়ায় থাকা মিয়ানমার কৌশলগত কারণে ওয়াশিংটনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ায় মার্কিন সেনা মোতায়েনের উদ্যোগকে যেমন চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা, মিয়ানমার সফরকেও তারই 'বর্ধিত' অংশ হিসেবে দেখছেন তাঁরা। নিউ ইয়র্কভিত্তিক এশিয়া সোসাইটির সুজানে দিমাগিও যেমন বলেন, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলসহ বিশ্ব অঙ্গনে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠা চীনকে ঠেকানোর যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ প্রচেষ্টার অংশ হিলারির মিয়ানমার সফর।
মিয়ানমারের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের এই আগ্রহী হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটেই গত সোমবার নেইপিদোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের ঘোষণা দেয় চীন। গতকালও হিলারির সফর শুরুর দিন চীন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, দীর্ঘদিনের বন্ধুরাষ্ট্র মিয়ানমারের স্বার্থহানি তারা মেনে নেবে না।
মার্কিন আইনপ্রণেতারা স্বীকার করেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাঁরা খুব কমই জানেন। বিপরীতে সম্ভাব্য মার্কিন আগ্রাসনের ব্যাপারে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বরাবরই উদ্বিগ্ন। এ উদ্বেগের বশবর্তী হয়ে ২০০৫ সালে আকস্মিকভাবে ইয়াঙ্গুন থেকে প্রত্যন্ত নেইপিদোতে রাজধানী স্থানান্তর করে তারা। এর তিন বছর পর ঘূর্ণিঝড় নার্সিগের আঘাতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে দেশটি। প্রায় এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মারা যায়। কিন্তু সে সময় মার্কিন সহায়তা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জান্তা সরকার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্তও এশিয়াজুড়ে খাদ্যদ্রব্য রপ্তানি করত মিয়ানমার। প্রাকৃতিক গ্যাসসহ বেশ কয়েকটি পণ্যও ছিল তাদের রপ্তানির তালিকায়। সাক্ষরতা ও স্বাস্থ্য খাতেও উল্লেখযোগ্য অবস্থানে ছিল দেশটি। তবে বর্তমানে মানব উন্নয়ন সূচকে বিশ্বের সবচেয়ে নিচের দিকে থাকা দেশটির অন্যতম মিয়ানমার। এ পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণ ঘটাতে সচেষ্ট মিয়ানমারের মানবিক পরিস্থিতিসহ সার্বিক উন্নয়ন ঘটাবে বলেই আশা করা হচ্ছে।
তবে এ পরিস্থিতিতে দেশটির সঙ্গে দুই 'প্রতিযোগী' পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বন্ধন সুদৃঢ় হবে, তাই এখন দেখার বিষয়। সূত্র : এএফপি, সিএনএন, বিবিসি।

No comments

Powered by Blogger.