মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ড-মূল আসামিরা ধরা পড়েনি, প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্ত্রীর আকুতি by সুমন বর্মণ,

রসিংদীবাসীর প্রিয় মেয়র লোকমান হোসেনকে হারানোর এক মাস হলো আজ পয়লা ডিসেম্বর। কিন্তু এত দিনেও লোকমান হত্যা মামলার প্রধান আসামিরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় হতাশা ও ভয়ে আছে সাধারণ মানুষ। সন্ধ্যা ৭টার পরপরই বেশির ভাগ দোকান এখনো বন্ধ হয়ে যায় শহরে। তদন্তের ধীরগতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মেয়রের স্ত্রী নুসরাত জাহান বুবলী। তিনি বিচার পাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি প্রার্থনা করেছেন।


এদিকে সন্ত্রাসীদের গুলিতে গত ১ নভেম্বর লোকমান হোসেনের নিহত হওয়ার তারিখ থেকে নরসিংদী পৌরসভার মেয়র পদটি শূন্য ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করেছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। এরই অংশ হিসেবে শিগগিরই মেয়র নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
লোকমান হত্যাকাণ্ডে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার হাজি ফারুককে ১০ দিনের রিমান্ড শেষে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। গতকাল বুধবার তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। একই দিন কাজী নূরে আলমসহ তিনজনের রিমান্ডের আবেদন মঞ্জুর করেছেন আদালত। নরসিংদীর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিতাই চন্দ্র দাস মামলার আসামি নূরে আলমের জন্য ১০ দিনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আট দিন এবং মাহফুজ হোসেন সবুজ ও শাহীনের জন্য পাঁচ দিনের আবেদনের স্থলে চার দিন মঞ্জুর করেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ তাদের রিমান্ডের আবেদন জানান।
স্ত্রী বুবলীর মিনতি : লোকমান হোসেনের স্ত্রী নুসরাত জাহান বুবলী গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার কোনো ভাষা নেই কিছু বলার। আমি একটা বিচারকের মেয়ে এবং বিচারকের বউ। মেয়র মানুষের সুবিচার করতেন এবং আমার বাবাও ন্যায়পরায়ণ বিচারক ছিলেন। অথচ আমি স্বামী হত্যার সঠিক বিচার না পাওয়ার শঙ্কায় আছি।' তিনি বলেন, 'আমার বাবা নেই, স্বামী নেই, আমি কার কাছে বিচার চাইব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া? এখন তিনি ছাড়া আমি কোনো গতি দেখছি না। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যদি একটি দয়া করেন, তাহলে আমি স্বামী হত্যার বিচার পাই।' তিনি আরো বলেন, 'আমার একটাই চাওয়া, স্বামী হত্যার বিচার। আমি প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রয়েছি। যদি কোনো কিছু না হয়, তাহলে জনগণকে নিয়ে আমি রাজপথে নামব। আমার জীবনের প্রতি কোনো মায়া নেই, ওনার সঙ্গে আমিও মৃত। আমার স্বামী পাঁচটি গুলি খেয়েছে, আমি ১০টি গুলি খাব, তবু স্বামী হত্যার বিচার করেই ছাড়ব।'

শিগগিরই নির্বাচনের তফসিল
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের গত ১৭ নভেম্বর জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন-২০০৯ এর ৩৩(২) ধারার বিধানমতে নরসিংদী পৌরসভার মেয়র পদে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন-২০০৯ এর ৩৩(২) ধারা অনুযায়ী পদ শূন্য ঘোষণার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। গত মঙ্গলবার বিকেলে প্রজ্ঞাপনের কাগজ নরসিংদী পৌরসভায় পেঁৗছেছে বলে জানান প্যানেল মেয়র জহিরুল ইসলাম।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিক গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা নরসিংদীর পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করছি। নিয়মানুযায়ী মেয়র পদে উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে।'

হত্যাকাণ্ডের এক মাস
১ নভেম্বর সন্ত্রাসীদের গুলিতে লোকমান নিহত হওয়ার পর ৩ নভেম্বর তাঁর ছোট ভাই কামরুজ্জামান বাদী হয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজি উদ্দিন আহমেদ রাজুর ছোট ভাই সালাহ উদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে প্রধান আসামি করে ১৪ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। এ মামলার আসামিদের মধ্যে শুধু আশরাফ হোসেন সরকার ১৫ নভেম্বর গ্রেপ্তার হয়েছেন। প্রধান আসামি ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজি উদ্দিন আহমেদ রাজুর ভাই সালাহ উদ্দিন আহমেদ বাচ্চুসহ অন্যান্য আসামি এখনো পলাতক। কয়েকজন রয়েছেন দেশের বাইরে।
তবে ঘটনাস্থল থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা মোটরসাইকেলের সূত্র ধরে ৮ নভেম্বর গাজীপুরের টঙ্গী থেকে হাজি সেলিমকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১২ নভেম্বর গোপালগঞ্জ থেকে কাজী টিপ্পন গ্রেপ্তার হয়। তাঁদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ ১৮ ও ১৯ নভেম্বর ঢাকা থেকে হাজি ফারুক ও নরসিংদী থেকে মাহফুজ, শাহিন ও নাসিরকে গ্রেপ্তার করে। সর্বশেষ গত সোমবার ভোরে কাজী নূরে আলমকে গ্রেপ্তার ও কবির হোসেনকে আটক করে পুলিশ।
লোকমান হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে আটজনকে। তাঁদের মধ্যে অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে তিনজনকে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে মাহফুজ, শাহিন ও আলম রিমান্ডে রয়েছে। আশরাফুল সরকার, হাজি সেলিম, ফারুক, কাজী টিপ্পন, নাসির ও কবির কারাগারে। তাঁদের মধ্যে আশরাফুল সরকার, হাজি সেলিম ও হাজি ফারুক আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
এদিকে একাধিক আসামির মামলা প্রত্যাহার ও মুক্তির দাবিতে শহরজুড়ে পোস্টার ও ব্যানার লাগানো হয়েছে। কারো কারো পরিবার সংবাদ সম্মেলনও করেছে। সেখানে আসামিদের পক্ষে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা সাফাই গেয়েছেন। হত্যা মামলার মূল আসামিরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে লোকমান হোসেনের পরিবার।
লোকমান হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী এক মাস সম্পর্কে জানতে চাইলে নরসিংদী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট এ কে ফজলুল হক বলেন, ঘটনার পর ধীরে ধীরে দোকানপাট খুললেও স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি নরসিংদী শহরের জনজীবন। আগে গভীর রাত পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন বিপণিবিতান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বেচাকেনা চলত। কিন্তু এখন আতঙ্কের কারণে ক্রেতা না থাকায় রাত ৭টার পরই ব্যবসায়ীরা দোকান বন্ধ করে ফেলছেন। তিনি বলেন, হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচারই পারে নরসিংদীর জনজীবনকে স্বাভাবিক করতে।
মামলার বাদী ও লোকমান হোসেনের ছোট ভাই কামরুজ্জামান বলেন, 'দীর্ঘ এক মাসে পুলিশের সফলতা বলতে শুধু এজাহারভুক্ত আসামি আশরাফ হোসেন সরকারের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি। এজাহারভুক্ত অন্য আসামিরা এখনো গ্রেপ্তার না হওয়া পুলিশের ব্যর্থতা। তাই পুলিশের কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট হওয়ার কিছু নেই। তবে আমরা আস্থাশীল। আমাদের বিশ্বাস, যেখানে প্রধানমন্ত্রী লোকমান হত্যার বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন, সেখানে পুলিশ অবশ্যই আসামিদের গ্রেপ্তার করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে।'
পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন, 'আমাদের আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। আমরা হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট থাকা কয়েকজনকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করেছি। তাঁদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। এতে হত্যা সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে আমাদের একটা ধারণাও এসেছে, কে কিভাবে হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে। যেহেতু এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, তাই প্রাপ্ত তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করছি। আশা করি, একটা সুন্দর তদন্ত সম্পন্ন করতে পারব। যার মধ্য দিয়ে প্রকৃত আসামিরা শনাক্ত হবে এবং বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াবে।'

No comments

Powered by Blogger.