জিন্নাত আলীর মৃত্যু : আইন শুধু লাশের সুরতহাল করে by লুৎফর রহমান রনো

শুরুতেই বলতে হয়, মেয়েসন্তানের মা কিংবা বাবা হওয়া যে একটি অভিশাপ_এই নেতিবোধ বাংলাদেশের মানুষের মনে বদ্ধমূল হতে চলেছে। সে জন্যই সহায়তা করে যাচ্ছে বাংলাদেশের অকার্যকর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। দেশের মানুষ তথাকথিত 'বখাটে' ও 'সন্ত্রাসী' নামের শ্বাপদের হাতে শতভাগ জিম্মি। সন্ত্রাসীর তাড়া খেয়ে বা হুমকি-ধমকিতে বিচলিত ব্যক্তি যখন পুলিশের কাছে সহায়তা প্রার্থনা করে_পুলিশ সাধারণ নাগরিকের আবেদন-নিবেদনে কর্ণপাত করে


না। ক্ষমতাসীন দলের লোক পরিচয় পেলে ভিন্ন আচরণ। দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশের কাছে আশ্রয়-আশ্বাস না পেয়ে নিরুপায় সে মানুষ নিজেকে সঁপে দেয় নিয়তির হাতে। আর নিয়তি নিয়ন্ত্রণ করে চলছে বখাটেরা। কলেজ-স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের উত্ত্যক্ত করবে, অপহরণ, ধর্ষণ করার মতলব আঁটবে, তাতে বাবা-ভাই প্রতিবাদ করলে সন্ত্রাসীর উদ্ধত ছোরা ওত পেতে থাকে। বুকে, পেটে বসিয়ে দিতেও দ্বিধা করে না। এমন এক অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে 'বখাটের' হাতে প্রাণ দিতে হলো একাদশ শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ের বাবা মুক্তিযোদ্ধা জিন্নাত আলীকে। জিন্নাত আলী একজন মুক্তিযোদ্ধা ও একজন সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে সমাজে যে মর্যাদা তাঁর ছিল, তাও তাঁকে রক্ষা করতে পারেনি। তাঁর অভিযোগও পুলিশ আমলে নেয়নি। থানায় তিনি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন, পুলিশ কোনো অ্যাকশন নিল না, অথচ দুর্বৃত্ত সে খবর ঠিকই পেল এবং আরো বেপরোয়া হয়ে উঠল, খুন করল...।
কয়েক মাস আগের পত্রিকার খবর_গ্রামের একজন কৃষক বাবা তাঁর মেয়ে লাঞ্ছিত হওয়ার খবর পেয়েছেন। কিন্তু সাহস পাননি প্রতিবাদ করতে। পুলিশ পর্যন্ত যাওয়ার পথ তো ওই বাবার জানাই নেই_অর্থাৎ তাঁর অজ্ঞতা নয়, আমাদের রাষ্ট্রের নাগরিক নিরাপত্তার মান এমনই। সেই বাবা দুঃসংবাদটি শুনেছিলেন মাঠে। সোজা বাড়িতে গিয়ে গাছে গামছা বেঁধে ঝুলে আত্মহত্যা করলেন। এই সেই আমাদের দেশ। বারো মাস দলাদলি, ভোটাভুটি, নেতা-পাতি নেতা, মেম্বার-চেয়ারম্যান, পুলিশ-দারোগা, টিএনও, সমাজ ও সমাজের তথাকথিত প্রভাবশালী কত্ত কিছু রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে গ্রাম-গ্রামান্তরে হাজার হাজার এনজিও। রাষ্ট্রের ওই ওপরতলা থেকে সমতল পর্যন্ত যে থরে থরে সাজানো সংস্থাগুলো রয়েছে। প্রান্তিক পর্যায়ে আনসার-ভিডিপি ও ইউনিয়ন পরিষদের পেয়াদা পর্যন্ত মাইনে পাচ্ছে। আর তাদের মাইনেসহ পুলিশ-দারোগা থেকে ওপরের দিকে একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে যে সংসদ সদস্য-মন্ত্রীরাও আছেন_সবাই বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। তা কোথা থেকে আসে? এই সাজানো-গোছানো দেশ, তাতে কোটি কোটি টাকার গাড়ি হাঁকানো, বাড়ি বাগানো, ক্ষমতার লাগাম মুঠিতে ধরে কী যে আত্মহারা সবাই_এতসবের আয়োজন তো করে দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। এসবের অর্থ জোগান দেন এখন ওই কৃষক_যিনি মেয়ের সম্ভ্রম রক্ষায় ব্যর্থ হয়ে গলায় গামছা দিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিলেন। মুক্তিযোদ্ধা জিন্নাত প্রতিবাদ করেছিলেন বলেই তো প্রাণ দিলেন। এমন অনেক স্কুলশিক্ষক, ভাই বা আত্মীয় বখাটেদের প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন।
মুক্তিযোদ্ধার মেয়ের সম্ভ্রম রাষ্ট্র রক্ষা করতে ব্যর্থ। বাবাদের বাঁচাতে ব্যর্থ। প্রতিদিন দেশের ঘরে ঘরে নারীরা খুন হচ্ছে। মেয়েরা যৌন হয়রানির কারণে আত্মত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। মেয়েসন্তানরা পর্যন্ত বুঝে নিয়েছে যে তাদের যদি কেউ উত্ত্যক্ত করে, তবে আর মুক্তি নেই। কারণ অভিভাবকদের প্রতিকার করার ক্ষমতা নেই। সমাজের সে বিবেক নেই, রাষ্ট্রের সেই সুনজর, সুশাসন নেই। তাই নিরুপায় হয়ে পড়লে তারা একমাত্র মৃত্যুই মুক্তির পথ মনে করে।
নগর-মহানগরের সুরক্ষিত এলাকাগুলো ছাড়া বোঝার উপায় নেই যে একটি রাষ্ট্র সংস্থা রয়েছে (আহা তাও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা)। রয়েছে তার অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো, যারা দেশের মানুষের শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত।
আজকাল পত্রিকা খুললে চোখে পড়বে দেশের একাধিক জায়গায় সন্ত্রাসী-খুনি-যৌন হয়রানিকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি দাবি করে মানববন্ধন, প্রতিবাদ সভা, মিছিল বা ক্লাস বর্জন কর্মসূচি পালন করছে। এতে পরিষ্কার যে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে নেমে এসেছে মানুষ ঘরে কিংবা কর্মস্থলে, ছাত্ররা স্কুল-কলেজে বসে থাকতে পারছে না। বাধ্য হয়ে বেরিয়ে আসছে পথে। পুলিশ যে নিয়মতান্ত্রিকভাবে দুষ্টের দমনে কর্তব্যরত নয়, বরং তার বিপরীত এ নিয়ম এখন প্রতিষ্ঠিত। তাই স্থানীয় প্রশাসন ও ঊর্ধ্বতন সংশ্লিষ্টদের কাছে জনগণ এভাবেই ফরিয়াদ জানাচ্ছে, যাতে চোখে পড়ে, বিবেকে বাজে, নৈতিকতার অবশিষ্টটুকু যেন জাগে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এসবও রাষ্ট্রের ভ্রূক্ষেপহীনতায় গতানুগতিক ও নিষ্ফল হয়ে পড়ছে।
বরিশালের আগৈলঝাড়ায় পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা শিক্ষিকা শারমিন প্রাণ হারালেন। এর প্রতিবাদে একাধিকবার এলাকার মানুষ, ছাত্র-শিক্ষক বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। ছাত্র-জনতার রোষ ও প্রতিবাদী চেতনা উপলব্ধি করতে পেরে ক্ষমতাসীন দল এবং প্রশাসনের টনক নড়েছে। এলাকার চিহ্নিত দুর্বৃত্ত এবং যুবলীগ ক্যাডার সে। এখন নাকি প্রশাসনের প্রধানরা, এলাকার নেতা ও প্রভাবশালীরা শারমিনের বাড়ি গিয়ে আশ্বস্ত করছেন তাঁর স্বজনদের। বলেছেন, খুনির ফাঁসি হবেই। এসব কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিধান নয় বা অপরাধ দমনের নিয়ম নয়। জনতার ঢল দেখে বা পরিস্থিতির মনস্তত্ত্ব বুঝে আইন চলবে! শারমিন জাহানের মা ঠিক কথাটাই বলেছেন, প্রশাসনের ও ক্ষমতাসীন দলের লোকদের এখনকার পরিবর্তিত আচরণ লক্ষ করে 'আমার কলিজার টুকরা শারমিনকে হত্যার পর... যেভাবে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন, তা যদি জিডি করার পর পরই করতেন, তাহলে তাকে হারাতাম না। ...আমরা চাই, খুনি, বখাটে আবুল গোমস্তার গডফাদারদের গ্রেপ্তারসহ শারমিন হত্যা মামলাটি আলোচিত মামলা হিসেবে দ্রুতবিচার আইনে নেওয়া হোক।'
পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা জিন্নাতের হত্যাকাণ্ডের পর এখন বরিশালের মানুষ প্রতিবাদমুখর এবং দলমত-নির্বিশেষে যেকোনো বখাটেপনা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ। এ ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। মানুষের, সমাজের এটাই স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। কিন্তু রাষ্ট্র বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষপাতিত্ব বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্যায় ও অনৈতিক উদাসীনতা সমাজে ভাঙন বা বিভেদ সৃষ্টি করে। আমরা সবাই আমাদের সামাজিক সত্যটা জানি। সমাজ সমাজপতি বা প্রভাবশালীদের মুঠোয় বন্দি। সামন্ত যুগে জমিদার, জোতদারদের জায়গায় এখন এসেছে রাজনৈতিক প্রশাসনিক ক্ষমতার এজেন্টরা। কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত প্রতি স্তরে এই অন্যায্য বিন্যাস রাজনৈতিক ক্ষমতার। এই ক্ষমতার বলে এখনো কোথাও কোথাও একজন ওসি বা এএসআই ব্রিটিশ যুগের দারোগার মতো ভয়ংকর হয়ে ওঠেন।
যাহোক, সামাজিক ঐক্য-চেতনা জরুরি। এটি মানবিক-নৈতিক পর্যায়ের বিবেচনা। কিন্তু আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে রাষ্ট্রের চোখ-কান খুলে দেওয়ার তৎপরতায়। তা ছাড়া স্থায়ী সমাধানে পেঁৗছানো যাবে না। একেক লাশের বিপরীতে খণ্ড খণ্ড সংগ্রাম আর ঐক্যবদ্ধতার দোহাই দিয়ে চলবে না। আমাদের কাজকর্ম, জীবন-সংসার নিয়ে উদয়াস্ত ব্যস্ত থাকতে হয়। এভাবে কতকাল চলবে? মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষক জিন্নাত আলীর মৃত্যুর পর সব পত্রপত্রিকায় খবর এসেছে, সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে। সম্পাদকীয়গুলোর শেষে লেখা হয়ে থাকে '...গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হোক। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এমন কাজ করতে সাহস না পায়...।' সেই ভবিষ্যৎ আর কত দূর? আর কত মেয়ের আত্মহত্যা, কত বাবার লাশ আর 'পুড়িয়ে', 'কুপিয়ে' কত গৃহবধূর হত্যাকাণ্ডের পর?
২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ পক্ষ ও বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালিত হচ্ছে। বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। সবাই নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে ১০ দফা দাবি জানিয়েছে জাতীয় মহিলা আইনজীবী পরিষদ। এই নিবন্ধে দাবিগুলো পুনরুল্লেখের দাবি রাখে_শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইনের বিষয়ে প্রস্তাবিত খসড়া আইনে পরিণত করা, মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের বিষয়ে প্রস্তাবিত খসড়াটি (২০১১) আইনে প্রণয়নসহ মানবপাচার বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, ভিকটিম-সাক্ষী সুরক্ষা আইনের প্রস্তাবিত খসড়া আইনে পরিণত করা, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার ও ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) সেবা তৃণমূল পর্যায়ে সম্প্রসারণ, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী এবং গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা ২০১০ খসড়ার আলোকে পূর্ণাঙ্গ আইন তৈরি, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১-এর সঠিক বাস্তবায়ন, পর্নোগ্রাফি প্রতিরোধে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন এবং ফতোয়ার নামে বিচারবহির্ভূত শাস্তি প্রদান বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা।
যুগ-যুগের পুঞ্জীভূত অন্ধকার দূর করতে সামাজিক অপরাধপ্রবণতার চরিত্র ও মাত্রা বিবেচনায় অনেক আইনেরই প্রয়োজন রয়েছে নারীকে সুরক্ষা, নারী অধিকার সংরক্ষণের স্বার্থে। কিন্তু মর্মাহত হতে হয় যখন দেখা যায় আইনবিদদের বইয়ের তাকে আইনের ভলিউমগুলো শোভা পাচ্ছে কেবল। ওদিকে জামিনে বেরিয়ে যাচ্ছে খুনি অবলীলায়। অর্থবিত্তের প্রভাব ও প্রভাবশালীদের প্রভাবমুক্ত আদালত ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী তৈরি করা ছাড়া কি হাওয়ার সঙ্গে লড়াইয়ের মতো নয়? তবুও আমাদের লড়তে হবে। ভাঙতে হবে অনেক কিছুই_গড়তে হলে স্বপ্নের সমাজ।
লেখক : সাংবাদিক
ronokk1969@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.