সাদাকালো-নাগরিক সমাজ ঢাকা বিভাজনের বিরোধী by আহমদ রফিক

ল্লিশের দশকের শেষদিকে যখন প্রথম ঢাকায় আসি, তখনকার গাছগাছালি ও ফুললতা-বুনোঝোপের বর্ণ-গন্ধ-রূপে ভরা ঢাকা, এখন আর তেমনটি নেই। থাকার কথাও নয়। রেসকোর্স ময়দানের দক্ষিণ দিকে দাঁড়ানো কালীমন্দির ও এর দেয়ালের বাইরে পলাশ ও হলুদ করবির গাছগুলো নেই। নেই এমনি অনেক কিছু। যেমন মালিবাগ-খিলগাঁওয়ের পুকুর, গাছপালা, কাঁচা রাস্তা, ইন্দ্রপুরি নামের দিঘি কিংবা পুরানা পল্টনের হলুদ রং একতলা বাড়িগুলো।


আবার আছেও অনেক কিছু। সারপেন্টাইন লেকের পাশে দাঁড়ানো বুড়ো শিরীষ আরো বুড়ো হয়েছে, কিন্তু বেশ আছে। ওর ছায়ায় এখনো তরুণরা বসে গল্প করে কি না জানি না। আছে লক্ষ্মীবাজার, কলতাবাজার মহল্লা_কিছুটা হলেও আপন বৈশিষ্ট্য নিয়ে। কিন্তু বন্ধুদের কেউ নেই। তা ছাড়া রয়েছে ভিক্টোরিয়া পার্ক (যদিও নাম 'বাহাদুর শাহ পার্ক'), লালকুঠি; নেই করোনেশন পার্ক। তবে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী বার লাইব্রেরি এখনো আছে। একসময় নতুন-পুরোনোর বিভাজক রেললাইন উঠে গিয়ে, দুইয়ের মেশামেশিতে শহর ঢাকা থেকে বৃহত্তর ঢাকা হয়ে এখন মহানগর ঢাকা। নানাভাবে সম্পর্কের সুতোটা বেশ দৃঢ় হয়ে উঠেছিল।
অবশ্য মহানগর হয়ে ওঠার কারণে বর্তমান নগরবাসীর জন্য ঢাকা অনেক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। সে দায় ঢাকার নয়, দায় শাসক বা পরিচালকদের অযত্ন, অবহেলা এবং নৈরাজ্যিক চিন্তাভাবনা ও কর্মকাণ্ডের। যেমন অভিযোগ পৌরসভার অপর্যাপ্ত সেবার মান, তেমনি দুর্নীতি নিয়ে। তবে আরো বহু সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা বুঝি যানজট। শেষোক্ত ক্ষেত্রে অবশ্য পৌরসভার কোনো দায় নেই।
আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাস, মহানগর ঢাকাকে চিরে দুভাগ করলেই সব নাগরিক সমস্যার অবসান ঘটবে, সেবার মান বেড়ে যাবে ইত্যাদি। জানি না, কে বা কারা তাঁকে এমন পরামর্শ দিয়েছে। হতে পারে, প্রধানমন্ত্রী নিজেই ভেবেছেন_সমস্যার সমাধান হিসেবে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করার কথা। কিন্তু ভাগ করলেই সমস্যা দূর হবে না, বরং সমস্যা বাড়বে। বাড়বে এর অর্থনৈতিক চাপের দিকটাও। সেবার মান বাড়ানোর অনেক উপায় আছে, সেসব নিয়ে লেখালেখিও হয়েছে অনেক। বিভাজনের ছুরি ব্যবহার না করে সেসব দিকে নজর দিলে ভালো হতো।
যদি দুর্নীতির কথাই ধরি (কেউ কেউ তা বলেছেন), তাহলে মানহানির আশঙ্কা মাথায় নিয়েই বলি, দুর্নীতি কোথায় নেই। কম আর বেশি, এই তো তফাত। তাই দুর্নীতির অভিযোগ দূর করার সঠিক উপায় তো হলো সংস্থাটিকে দুর্নীতিমুক্ত করার চেষ্টা চালানো। ভাগ করা তো দুর্নীতি নিরসনের উপায় নয়। বরং দুই ভাগে দুর্নীতির পরিমাণ আরো বেশি হয়ে দাঁড়াবে। প্রাসঙ্গিক কথায় বলি, বিভাজনে যানজট বিভাজিত হবে, কমবে না। যানবাহন, পরিবহন, রাজপথ-জনপথ সঠিক পরিকল্পনায় না আনলে যানজট কমারও সম্ভাবনা নেই।
মূল বিষয়টা যেখানে সেবা, সেখানে অসংখ্য সমস্যা_জনবল, অর্থবল, আন্তসংস্থা জটিলতা ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে সেবার নিশ্চয়তা দিতে নগর করপোরেশনের বিধিবিধান ঢেলে সাজাতে হবে। যেমন আমরা আগেও বলেছি, ক্ষমতায়নের ব্যাপারে 'নগর সরকার' ব্যবস্থার কথা, যা ছিল ঢাকার একজন সফল মেয়র মোহাম্মদ হানিফেরও কথা। একাধিক ডেপুটি মেয়রসহ দুর্নীতিমুক্ত করপোরেশনের কথাও ভাবা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের কঠোর খবরদারি থাকবে না।
আমাদের কথা হলো, ঢাকা ভাগ করা হলে বর্তমান সমস্যার তুলনায় সমস্যা আরো বাড়বে, কথাটা অনেকে বলেছেন। তাতে ঢাকার সাংস্কৃতিক চিত্র যেমন দ্বিভাজিত হবে, তেমনি ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়াবে সেবার অবকাঠামো তৈরির বিষয়টি। এমনকি সমস্যা হবে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ইত্যাদি সরবরাহকারী সংস্থাগুলোর বিভাজন নিয়ে। সে হবে এক এলাহি কাণ্ড!
ঢাকা ভাগ, করপোরেশন ভাগের কারণে সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক সব সমস্যা বানের জলের মতো তেড়ে আসবে। সেগুলো সামলানো বড় কঠিন হবে। তার চেয়ে বরং আমরা মূল সমস্যা সমাধানের জন্য সবাই মিলে চেষ্টা করি না কেন। প্রধানমন্ত্রীও পারেন এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত নিতে। ঢাকাকে অবিভক্ত রেখে সমস্যার সমাধান।
তা ছাড়া আরো একটি তাত্তি্বক সমস্যা আছে এ বিভাজনের। আইন বিশেষজ্ঞ সুলতানা কামাল ঠিকই বলেছেন, এ বিভাজন বাংলাদেশের 'সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।' তার মতে, 'জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এ ধরনের আইন প্রণয়ন করা উচিত নয়।' আর যে আইনবলে এটা করা হচ্ছে, 'ওই আইনও অসাংবিধানিক'। আমরা সাধারণ নাগরিক আইনের মারপ্যাঁচ বুঝি না, শুধু এটুকু বুঝি, যে বিভাজন নিয়ে সমাজের সব স্তরে এত আপত্তি তা নিছক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদে পাস করানোটা গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ হবে না। বরং প্রধানমন্ত্রী এক কাজ করুন : বিভাজন নিয়ে গণভোটের ব্যবস্থা করুন। বিষয়টা খুব ব্যয়বহুল হবে না। দেখা যাক, ঢাকা মহানগরবাসী মানুষ কী চায়। বলছি এ জন্য যে সব দলের কমিশনাররাই চাচ্ছেন ঢাকা নগর করপোরেশন তথা ঢাকা অবিভক্ত থাকুক।
আগেও বলেছি, এবারও বলি_ঢাকার সমস্যা, নগর পৌরসভার সমস্যার একটি অন্যতম প্রধান কারণ মহানগরের দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি। এ সমস্যার সমাধানও ঢাকা বিভাজন নয়। সমাধানের জন্য দরকার গোড়ায় হাত দেওয়া, যদিও তা কিছুটা দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থা হলো গ্রামের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন, উপার্জনের পথ তৈরি ও ছোট ছোট কুটির শিল্পের বিকাশ ঘটানো। এ কাজ এনজিওদের দিয়ে এ যাবৎ হয়নি, কখনো হবে না। তাই দরকার সরকারপক্ষের পরিকল্পনা, অর্থনৈতিক অনুদানের ব্যবস্থা_যাতে গ্রামগুলো কিছুটা হলেও স্বনির্ভর হতে পারে, যাতে তাদের দুমুঠো ভাত ও নিশ্চিন্ত জীবনের জন্য রাজধানী ঢাকায় ছুটে আসতে না হয়। মুক্ত পরিবেশের জীবন ছেড়ে কে যায় বস্তির ঘিঞ্জি জীবনের বন্দিত্বে প্রবেশ করতে? এ ব্যবস্থায় কিন্তু জাতীয় প্রবৃদ্ধি কিছুটা হলেও গতিশীল হবে।
ঢাকার ওপর জনসমাগমের চাপ কমাতে হলে আরো দরকার স্থানীয় সরকারব্যবস্থা যথাসাধ্য বিকেন্দ্রীকরণ এবং তা আরো মজবুত ও শক্তিশালী করা, কার্যকর করা। সত্যি বলতে কি, গ্রামে অধিকতর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার কোনো বিকল্প নেই এবং তাতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে কিছু মাত্রায় সুবাতাস বইতে পারে। এমনি আরো একাধিক পথে ঢাকার ওপর থেকে চাপ কমানো সম্ভব।
প্রধানমন্ত্রী এ বিভাজন প্রসঙ্গে বলেছেন : 'আমাদের বিবেচনা কেবল একটাই, তা হচ্ছে মানুষ কতটুকু সেবা পাবে।' জনসেবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর এ ব্যাকুলতা প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এর জন্য আমাদের বহু পরিচিত প্রিয় ঢাকা, সংবিধানের ঢাকাকে কেটে দুই ভাগ না করেও সেবা নিশ্চিত করার একাধিক উপায় রয়েছে, প্রধানমন্ত্রী সেদিকে নজর দিচ্ছেন না কেন? ঢাকা বিভক্ত হলে উত্তর ঢাকার নদীপ্রেমী মানুষ দাবি করতে পারে, 'আমার বুড়িগঙ্গা চাই'। অর্থাৎ বুড়িগঙ্গার ভাগ চাই।
ঢাকার সঙ্গে বুড়িগঙ্গার আ@ি@@@ক সম্পর্ক। ছোটবেলায় পড়া 'ঢাকা বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত' কথাগুলোর জন্যই নয়, বুড়িগঙ্গার সঙ্গে আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের অনেক সম্বন্ধ, যেমন সম্বন্ধ পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী অনেক কিছুর সঙ্গে_যে কথা আগে বলা হয়েছে। এমন অনেক কারণে প্রধানমন্ত্রীকে নগর পৌরসভা বিভাজনের বিষয়টি নিয়ে দ্বিতীয় চিন্তা করতে অনুরোধ জানাই। বিভাজনের হঠাৎ প্রস্তাব ঢাকার উত্তরাঞ্চলের অধিবাসীদের আহত করেছে, যেমন করেছে পুরান ঢাকার মানুষজনকেও।
সত্যি বলতে কি, এ বিভাজনের প্রস্তাব নগরবাসীর মধ্যে বেশ আলোড়ন তুলেছে। আমার এক বন্ধুর ধারণা (তার ধারণা ভুলও হতে পারে), এ বিভাজনের পেছনে অন্য কারণ রয়েছে। সে কারণটা রাজনৈতিক, যে কারণে দীর্ঘদিন মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পারও মেয়র পদে নির্বাচন দেওয়া হচ্ছে না, নির্বাচন কমিশনের তাগিদ সত্ত্বেও। আর সে জন্য বিরোধীদলীয় রাজনীতিক দীর্ঘসময় ধরে মেয়র পদে আসীন।
তা সত্ত্বেও নির্বাচন না দেওয়ার কারণ নগর ঢাকায় ক্ষমতাসীন দলের দুই নেতার দ্বন্দ্ব এবং তা মহানগরকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। তাই ঢাকা পৌরসভা উত্তর-দক্ষিণে বিভাজিত হলে দুজনেরই একটা ব্যবস্থা হয়ে যায়, তাই পৌরসভা বিভাজন। অর্থাৎ এক ঢিলে দুই পাখি মারা। প্রসঙ্গত ঢাকার অখণ্ডতা বাঁচাতে সাদেক হোসেন খোকার সম্প্রতি মেয়র পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার ঘোষণার জন্য তাঁকে সাধুবাদ জানাই। তবে তিনি যেন শেষতক তাঁর কথা রাখেন। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, শুধু দলনির্বিশেষে সব ওয়ার্ড কমিশনারই নন, ঢাকা নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিবৃত্তিক বলয়ের সব মানুষ এই বিভাজনের বিপক্ষে। এদের সিংহভাগ কিন্তু বর্তমান সরকারের সমর্থক।
সে জন্যই প্রধানমন্ত্রীকে সবিনয়ে বলি, ঢাকার জনসমাজের মতামত নিয়ে তবেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিন। আমাদের বহু দিনের চেনা ঢাকা বিভাজিত করে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন না। বরং সংশ্লিষ্ট নগর-বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় সরকার বিশারদদের মতামতের ভিত্তিতে সিটি করপোরেশনকে কর্মে গতিশীল, সেবাব্রতী ও দুর্নীতিমুক্ত করে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। তাই হবে সমস্যা সমাধানে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ।
অভিজ্ঞ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠকে ঠিকই সিটি করপোরেশনকে সুস্থ ও কর্মতৎপর করার উপায় বেরিয়ে আসবে। সেই সঙ্গে নিজের ভাবনা যোগ করে একটা সঠিক লক্ষ্যে পেঁৗছানো সম্ভব হতে পারে। তাতে আপনার দলের জনপ্রিয়তা বাড়বে, লাভ বই লোকসান হবে না। ঢাকাবাসী এমন এক পদক্ষেপের জন্য ভবিষ্যতে আপনাকে মনে রাখবে।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক, প্রাবন্ধিক, কবি

No comments

Powered by Blogger.