মন চলে যায় নর্দাম্পটনে by কামরুল হাসান

খালেদ মাহমুদ, আকরাম খান, মিনহাজুল আবেদীন, আমিনুল ইসলাম, খালেদ মাসুদ, নাঈমুর রহমান_তাঁরা প্রত্যেকেই খেলা ছেড়েছেন বেশ আগে। কিন্তু এখনো নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও দেখা হয়ে যায় তাঁদের। একথা সেকথার পর হয়তো ঘুরে ফিরে আসে এক যুগ আগের সেই স্মরণীয় ম্যাচটার কথাও। স্মৃতির সিন্দুক খুলে বের করে আনেন মনিমুক্তায় জড়িয়ে রাখা সেই অমূল্য ধন_পাকিস্তানবধ কাব্য। দেশে-বিদেশে যত বার পাকিস্তানের মুখোমুখি


হবে বাংলাদেশ তত বার ঘুরে ফিরে আসবেই সেই ম্যাচের স্মৃতি। লিখেছেন কামরুল হাসানসেদিনের পর থেকে সূর্যকে ১২ বার ঘুরে এসেছে পৃথিবী। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা দিয়েও গড়িয়ে গেছে অনেক জল। সেদিন যে কিশোর বাংলাদেশের জয় দেখে পতাকা হাতে নেমে পড়েছিল ঢাকার রাস্তায়, আজ হয়তো সে টগবগে যুবক। এক যুগ কম সময় তো নয়!
কত কিছু বদলেছে এই এক যুগে। সেদিনের আকরাম খান আজ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচক। সঙ্গে সেই মিনহাজুল আবেদীন। নর্দাম্পটন মাঠে সেদিনের সতীর্থ এখন নির্বাচক প্যানেলে সহকর্মী। তখনকার অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল খেলা ছেড়ে এখন পুরোদস্তুর কোচিং পেশায়। আর জয়ের নায়ক খালেদ মাহমুদ সুজন? তিনিও খেলা ছেড়েছেন বেশ আগে। তাই কখনো ভাষ্যকার, কখনো জাতীয় দলের সহকারী কোচ_এমন নানা ভূমিকার পর ইদানীং টেলিভিশনের ক্রিকেট-বিষয়ক অনুষ্ঠানের সঞ্চালকও! কোথাও না কোথাও, কখনো নিশ্চয়ই দেখা হয়ে যায় তাঁদের। এ-কথা সে-কথার পর হয়তো ঘুরে-ফিরে আসে এক যুগ আগের সেই স্মরণীয় ম্যাচটার কথাও। স্মৃতির সিন্দুক খুলে বের করে আনেন মণি-মুক্তায় জড়িয়ে রাখা সেই অমূল্য ধন_পাকিস্তানবধ কাব্য। আজ থেকে প্রায় ১২ বছর আগে অসাধারণ এক বীরত্বগাথায় যে কাব্য লিখেছিলেন আমাদের আকরাম-আমিনুল-মিনহাজ-খালেদ মাহমুদরা। দেশে বিদেশে যত বার পাকিস্তানের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ তত বার ঘুরে-ফিরে আসবেই যে ম্যাচের স্মৃতি!
৩১ মে, ১৯৯৯। নর্দাম্পটনের কাউন্টি গ্রাউন্ডে বিশ্বকাপের বি গ্রুপের ম্যাচটা খেলার জন্য যখন বাংলাদেশ অধিনায়ক টস করতে যাচ্ছেন পাকিস্তানের অধিনায়ক ওয়াসিম আকরামের সঙ্গে, ততক্ষণে সবাই জেনে গেছে এ ম্যাচে পাকিস্তানের হারানোর কিছু নেই। গ্রুপ পর্যায়ে আগের সব ম্যাচ জিতে সুপার সিঙ্ নিশ্চিত করে রেখেছে পাকিস্তান। পাওয়ার ছিল বাংলাদেশের। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে তারা নিজেদের গ্রুপে স্কটল্যান্ডকে হারিয়েছে তবে সেটা অনেক কষ্টেসৃষ্টে। ওই জয় ছাড়া ওয়ানডে স্ট্যাটাস পাওয়ার পর আর একটা মাত্র জয় ছিল ভারতের কোকাকোলা কাপে কেনিয়ার বিপক্ষে। সব মিলিয়ে এক দিনের ক্রিকেটে দুটো মাত্র জয়, যার কোনোটাই কোনো টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে নয়। অথচ অভিজাত সেই ক্লাব তখন হাতছানি দিয়ে ডাকছে বাংলাদেশকেও। তখনও ক্রিকেটের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। টুর্নামেন্টের হট ফেভারিটকে হারিয়ে কিছু একটা করে ফেলার স্বপ্ন তাই বামন হয়ে চাঁদ ছোঁয়ার মতোই অলীক। টসে হেরে আমিনুল ইসলাম বুলবুলরা যখন ব্যাট করতে নামেন তখনও কিন্তু মনে হয়নি এদিনের গল্পটা অন্য রকম হতে পারে!
ওয়াকার ইউনিস, শোয়েব আখতার আর ওয়াসিম আকরামকে নিয়ে গড়া পাকিস্তানি পেস ব্যাটারি। সেটা বেশ ভালোই সামাল দিতে শুরু করেছিলেন শাহরিয়ার হোসেন আর মেহরাব হোসেন। মেহরাব প্রত্যাশার চেয়ে একটু ধীর, কিন্তু ওপাশে শাহরিয়ার ছিলেন তাঁর স্বাভাবিক ছন্দে। ১৬তম ওভারে এসে দুজনের ওপেনিং জুটিটা ভাঙলেন সাকলায়েন মুশতাক, ৪২ বলে ৯ রান করা মেহরাবকে ফিরিয়ে দিয়ে। কিন্তু ততক্ষণে টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ওপেনিং জুটিটা গড়া হয়ে গেছে। দলীয় ৬৯ রানে মেহরাব ফিরে যাওয়ার পর আর এক রান যোগ করেই প্যাভিলিয়নের পথ ধরলেন শাহরিয়ারও (৬০ বলে ৩৯)। এবারও ঘাতক সাকলায়েন। সবচেয়ে অভিজ্ঞ দুই ব্যাটসম্যান আকরাম আর আমিনুল এরপর চেষ্টা করলেন ইনিংসটা মেরামত করার। দুজনের ৫০ রানের জুটির পর আবার আঘাত হানলেন শহীদ আফ্রিদি। ওই ম্যাচ খেলা একমাত্র ক্রিকেটার যিনি এখনো আছেন পাকিস্তান দলে! তাঁর শিকার হলেন আমিনুল (২৬ বলে ১৫)। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোরার আকরাম খানকে (৬৬ বলে ৪২) ফেরালেন ওয়াকার ইউনিস। স্কোর তখন ৪ উইকেটে ১৪৮, ৩৫ ওভারের খেলা চলছে। সেখান থেকে লড়ার মতো পুঁজি গড়ার বাকি কাজটা করেছিলেন খালেদ মাহমুদ (৩৪ বলে ২৭) আর খালেদ মাসুদ (২১ বলে ১৫)। মূলত লোয়ার অর্ডারে এই দুজনের ব্যাটিংয়ে ভর করেই ৯ উইকেটে ২২৩ রানের সম্মানজনক স্কোর দাঁড় করায় বাংলাদেশ। সম্মানজনক, কারণ এর আগের চারটি ম্যাচের কোনোটাতেই ২০০ রান পেরোতে পারেননি আমিনুলরা। ১০ ওভারে ৩৫ রান দিয়ে ৫ উইকেট নিলেন সাকলায়েন। পাকিস্তানের হয়ে সেদিনের সবচেয়ে সফল বোলার হয়তো তখনও বুঝতে পারেননি শুধু এটুকু যথেষ্ট হবে না তাঁর দলের জন্য!
ব্যাটিংয়ের চেয়ে বোলিংয়ের শুরুটা হলো আরো দুর্দান্ত। খালেদ মাহমুদের করা প্রথম ওভারের পঞ্চম বলেই শহিদ আফ্রিদি (২) আউট। শফিউদ্দিন আহমেদের পরের ওভারে প্যাভিলিয়নের পথ ধরলেন ইজাজ আহমেদও (০)। ৭ রানে পাকিস্তানের ২ উইকেট ফেলে দেওয়া ক্রিকেটের 'নিম্নমধ্যবিত্ত' বাংলাদেশের তখন হঠাৎ করে উচ্চবিত্ত হয়ে ওঠার স্বপ্ন! সেই স্বপ্নটা আরো ডালপালা মেলল যখন একে একে প্যাভিলিয়নের পথ ধরলেন সাইদ আনোয়ার (৯), ইনজামাম উল হক (৭) আর সেলিম মালিকও (৫)। ৪২ রানে পাকিস্তানের ৫ উইকেট নেই। ব্যাট হাতে জ্বলে ওঠার পর জীবনের সেরা বোলিংটাও করে ফেললেন খালেদ মাহমুদ (৩/৩১), যা তাঁকে পরে এনে দিয়েছিল ম্যান অব দ্য ম্যাচের সম্মানও। আজহার মাহমুদ আর ওয়াসিম আকরাম দাঁড়ালেন প্রতিরোধের দেয়াল গড়ে। কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য নয়। ২৯ রান করা আজহার রান আউট হলেন, এর এক ওভার পর মিনহাজুল আবেদিনের শিকার হলেন ওয়াসিম আকরামও (২৯)। একই চেষ্টা মইন খান (১৮) আর ওয়াকার ইউনিসেরও (১১), কিন্তু জয়ের নেশা ততক্ষণে পেয়ে বসেছে বাংলাদেশকে। ব্যাট হাতে শেষ বাধা হয়ে ছিলেন বল হাতেও দারুণ পারফর্ম করা সাকলায়েন মুশতাক। কিন্তু ৫১ বলে খেলা তাঁর ২১ রানের সংগ্রামী ইনিংসটা শেষ হয় খালেদ মাসুদের দুর্দান্ত রান আউটের মাধ্যমে। ৪৪.৩ ওভারে, ১৬১ রানে অলআউট পাকিস্তান!
৬২ রানে ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। নর্দাম্পটন যেন কিছুক্ষণের জন্য হয়ে উঠল ঢাকা!
আর ঢাকা? সেদিনের বিজয় মিছিলের স্মৃতি নিশ্চয়ই আজও টাটকা অনেকের মনেই। নাহ, একটু ভুল হলো। সবার মনেই।

No comments

Powered by Blogger.