গ্রিস-ইতালি-পশ্চিমা তরুণদের চোখ ফেরানো যাবে কি? by ফারুক যোশী

৭ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া ওয়াল স্ট্রিটের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীর দেশে দেশে। সারা পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে একটা লুটেরা শ্রেণীর হাত থেকে অর্থনীতির চাকাকে বের করে আনার প্রত্যয় নিয়ে শুরু হয়েছিল এ আন্দোলন। ওয়াল স্ট্রিটের আন্দোলন উপেক্ষিত হয়েছিল প্রথমদিকে। উন্নত দেশগুলোতে যা হয়। শ্রমিক কিংবা বেকারদের যেকোনো আন্দোলনকেই আমেরিকা কিংবা ব্রিটেনের মতো দেশগুলোতে গাঁজাখোর কিংবা


বোহেমিয়ানদের ভেরেন্ডা ভাজা হিসেবেই চিহ্নিত করার চেষ্টা চলে। এ আন্দোলনও হয়তো তা-ই হতো। কিন্তু তা হয়নি। কারণ পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা যেন এক চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে আমেরিকা কিংবা ইউরোপের দেশগুলোতে। তাইতো শত চেষ্টা করেও বেকারত্ব রুখতে পারছে না তারা। একটা বেকার বোহেমিয়ান-শ্রেণী সৃষ্টি হচ্ছে দিনের পর দিন এবং এই শ্রেণী যে কার্ল মার্কস কিংবা লেনিনের ভাবধারা থেকে উঠে আসছে, তা বলা যাবে না। এই শ্রেণী তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই সমাজতন্ত্রের জন্যও মাঠে নামেনি। স্রেফ বেঁচে থাকার জন্য, সামান্য বাড়িয়ে বললে বলা যায় বিশ্বশান্তির একটা স্লোগান নিয়ে এরা মূলত একটা শোষকগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে এ থেকে আমেরিকাকে মুক্ত করার অভীপ্সা নিয়েই হয়তো তাদের মাঠে নামা। আর এ থেকেই শুরু পৃথিবীর দেশে দেশে এ আন্দোলন। ওয়াল স্ট্রিটের এ আন্দোলন ঝিমিয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু আন্দোলনকারীরা পার্ক ছেড়ে যায়নি। চলছে তাদের একে একে ঘেরাও ও অন্য সব কর্মসূচি।
আমেরিকার এ আন্দোলন ইউরোপেও ধাক্কা দিয়েছে। ধাক্কা যেমন এসেছিল মিসরে, তিউনিসিয়ায় কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এক বছর ধরে। হয়তো লিবিয়ায়ও। ঠিক তেমনি ইউরোপেও এ ধাক্কা সামাল দিতে হচ্ছে। এই সামাল দিতে গিয়ে ইউরোপের একটি দেশ আজ দেউলিয়া। গ্রিস নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই চলছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের শঙ্কা। বিশাল বিশাল ঘেরাও-বিক্ষোভ দেখছে এখন গ্রিসের মতোই ইউরোপের জনগণ। গ্রিসের অর্থনৈতিক মন্দা সারা দেশ যেন গ্রাস করে ফেলেছে। ২১ জুলাই ইউরোপীয় ইউনিয়ন গ্রিসের জন্য একটা বড় ধরনের সাহায্য প্যাকেজের ঘোষণা দিলেও কিছুই হচ্ছে না। গ্রিস সামাল দিতে পারছে না নিজেদের। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ঐক্য আর এতে ব্রিটেনের ভূমিকা নিয়ে ইউরোপের শক্তিশালী দেশগুলো ক্ষেপেছে এবার। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি তো বলতে গেলে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনকে দেখে নিয়েছেন। অপমান করে বলেছেন, একটা নিঝুম দ্বীপ থেকে আসা ক্যামেরন কি-ই ঝুঝবেন। ইউরোপের অনুভূতি বোঝার সাধ্য হয়তো ক্যামেরনের নেই। এ রকম বাক্যবিনিময়ের একপর্যায়ে ক্যামেরনের টরি দলের এক এমপি ফিলিপ ডেভিস বলেছেন, আমরা কী বলতে চাই, তা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট শুনতে চান না। তিনি শুধু তাঁর হাত আমাদের অর্থের ওপর রাখতে চান। এ রকম তির্যক কথাবার্তার মধ্য দিয়েই তাইতো এবার ফ্রান্সে জি-২০ সামিট যেন ছিল গ্রিসের আলোচনায় মুখর। বিশ্ব-অর্থনীতির বাজার নিয়ে এখানে আলোচনার কথা, অথচ মূল কেন্দ্রবিন্দুই যেন ছিল গ্রিস-ইতালি তথা ইউরো জোন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট যা-ই বলুন না কেন, দেশের মানুষের প্রবল প্রতিবাদেই হয়তো ব্যর্থতার দায় নিয়ে গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী জর্জ পাপেন্দ্র শেষ পর্যন্ত পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন, সেখানে গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ঠিক একইভাবে ইতালিতেও চলছে মন্দা। ইতালির প্রধানমন্ত্রীও সেই একই পথে। গ্রিসের পরেই ইতালি। দেশটিতে সহিংসতাও কম হচ্ছে না। ১.৬ ট্রিলিয়ন পাউন্ডের বোঝা নিয়ে পথ চলতে পারছে না যেন ইতালি। গ্রিসকে সামাল দেওয়াই জটিল, এ সময় আবার ইতালিও ডুবে আছে ঋণের বোঝায়। ইউরোপিয়ানরা এখন কী করবে?
ব্রিটেনের মানুষগুলো কি সুখে আছে। ব্রিটেনের অর্থনীতি কিংবা সমাজ কতটুকুই বা নিরাপদ_এ প্রশ্ন পিছু ছাড়ছে না বর্তমান ব্রিটেন সরকারের। গ্রিস বলি আর ইতালি বলি_ব্রিটেনেও সেই একই ধারাবাহিকতা। ২.৪ মিলিয়ন মানুষ বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ মানুষগুলোর কাজ নেই কোথাও। বিশেষত তরুণদের একটা বিরাট অংশ এই বেকারত্বের নির্মম শিকার। সরকার ভর্তুকি দিয়ে চালাচ্ছে এই বেকারদের। ব্যয় সংকোচন চলছে, তাও দীর্ঘদিন ধরেই। ব্যয় সংকোচন মানেই চাকরি থেকে ছাঁটাই ও চাকরিহীন মানুষ। এই যখন ব্রিটেনের সামগ্রিক অবস্থা, ঠিক তখনই ব্রিটেনের অন্য চিত্র। ব্যাংকগুলো বানাচ্ছে মিলিয়ন-বিলিয়ন পাউন্ড। বড় বড় সুপার মার্কেটের শাখাগুলো বাড়ছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছোট আর মাঝারি ব্যবসা। এলিট আর করপোরেট বাণিজ্যে যে শ্রেণীটা বেড়ে উঠছে, তাদের ওয়াল স্ট্রিটের আন্দোলনকারীদের ভাষায়ই বলতে হয়, এরাও এক ধরনের শোষক শ্রেণীই। এই শ্রেণীকে ছায়া দেয় পৃথিবীর সব দেশেই শাসকগোষ্ঠী।
আসলে পশ্চিমা সভ্যতা এমন এক অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখান থেকে উত্তরণে তারা যেন একের পর এক নির্ভর করছে প্রাচ্য কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর দিকে। ব্যবসা-সেবার নাম নিয়ে লুণ্ঠন-বাণিজ্যই এখন তাদের প্রধান অবলম্বন। আর সে জন্যই হয়তো আবার মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে নতুন ভাবনায় আছে ওবামা-ক্যামেরন প্রশাসন। ইরান নিয়ে জল্পনা চলছে। লিবিয়ার শেষ পরিণতি দেখে এবার তারা ইসরায়েলের মদদেই ঝুঁকতে চাইছে ইরানের দিকে। ব্রিটেনের ডেইলি মেইল এ ইঙ্গিত দিয়েছে গত সপ্তাহে। কিন্তু সমসাময়িক ইতিহাস সব কিছুরই হিসাব যেন পাল্টে দিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে যে বসন্ত হাওয়ার কথা বলছে পশ্চিমা শাসকরা, সেই পশ্চিমের দেশগুলোতেও হাওয়া লেগেছে পালাবদলের। গ্রিসে পরিবর্তন এসেছে। আসছে ইতালিতেও। দেশ দুটোতে সহিংসতা রোধ করতে হয়তো এর কোনো বিকল্পও নেই দেশ দুটোর প্রধানমন্ত্রীদের। ব্রিটেনও দখল সামলেছে। একটা ছাত্রদের, অন্যটি সাম্প্রতিক রায়ট বা দাঙ্গার। সারা ইউরোপের মতো ব্রিটেনেরও এ এক ভাবনার ব্যাপার। জেগে উঠলে মানুষ বিশেষত তরুণরা_এদের রুখতে গেলে এদের দাবি-দাওয়াকে প্রাধান্য দিতেই হবে। ব্রিটেন কি পারবে শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের কর্মব্যস্ত রাখতে? যদি না পারে তবে গ্রিস-ইতালির চিত্র এখানেও বিচিত্র নয়। পশ্চিমের সব দেশই যেন অস্থির সময় পার করছে। এই অস্থির সময়েরই প্রতিবিম্ব ওয়াল স্ট্রিট দখলের আন্দোলন। সুতরাং আরবের বসন্তকে উসকে দিয়ে আরব দখলের ইচ্ছাও একসময় লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যেতে পারে। পশ্চিমের গণমাধ্যমে যুদ্ধের অনিবার্যতা দেখিয়ে দেশগুলোর সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করার যতই চেষ্টা চলুক না কেন, অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার কাছে তা কল্কে নাও পেতে পারে। বাস্তবতার কাছে মিডিয়ার প্রচার-প্রচারণাও অনেক সময় কুলিয়ে উঠতে পারে না। তাইতো ইতালির প্রধানমন্ত্রী মিডিয়া টাইকুন হিসেবে পরিচিত থাকলেও ইতালির বাস্তবতার কাছে কোনো প্রচার-প্রচারণাই তাঁকেও ক্ষমতায় থাকতে দেয়নি। তাঁকেও পদত্যাগ করতে হয়েছে। সুতরাং এখন ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন হোক আর ইউরোপের রাস্তায় রাস্তায় সহিংসতা হোক_সব কিছুই মূলত একই সুতোয়ই গাঁথা। নামটা হয়তো ভিন্ন। ফেইসবুক-টুইটার নামের সামাজিক নেটওয়ার্ক আরো সহজ করে দিয়েছে সব কিছু। আন্দোলনের জন্য এখন আর বড় গণমাধ্যমের প্রয়োজন নেই। মিসর দেখিয়েছে তা, তিউনিসিয়া শিখিয়েছে তা। আর পশ্চিমা দেশগুলোর তো ঘরে ঘরেই কম্পিউটারে আঙুলের চাপাচাপি, হাতে আইফোন কিংবা ব্লেকবারি। সুতরাং নতুন নতুন যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে তরুণ-তরুণীদের চোখ ফেরানো যাবে না এখন ইউরোপ-আমেরিকা কিংবা পশ্চিমের দেশগুলোতে।
লেখক : লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক
faruk.joshi@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.