জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রবিক্ষোভ ছাত্রলীগ ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবেরভূমিকায় by মো. মাহফুজুর রহমান

জ এ লেখাটি যখন লিখছি তখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এক সপ্তাহ অতিক্রম করে দ্বিতীয় সপ্তাহে পদার্পণ করেছে। শিক্ষার্থীদের ওপর হয়েছে অকথ্য ও অন্যায্য পুলিশি এবং ছাত্রলীগের নির্যাতন। সাধারণ মানুষ থেকে মন্ত্রী পর্যায় পর্যন্ত অনেকেই বলেছেন, হঠাত্ করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মানে কী? কিন্তু হঠাত্ করে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়নি বা এ আন্দোলন আকস্মিক কোনো বিষয় নয়। এ আন্দোলন চলে আসছে অনেক দিন ধরে।

শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন বহু দিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, বেদনা, দুঃখ, যন্ত্রণা এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের সমাহার। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সময় টিভিতে এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনে বিএনপির উস্কানি থাকতে পারে । কিন্তু আমি বলবো—মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, আপনি যদি আন্দোলনের দিনগুলোয় ক্যাম্পাসে আপনার পদধূলি দিতেন, তাহলে দেখতেন এখানে-------নিয়ে কেউ আন্দোলনে আসেনি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যায়ের ২৩-২৪ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে আপনাদের পোষা গুটিকয়েক শিক্ষার্থী বাদে সবাই আন্দোলনে নেমেছে। বলতে পারেন আন্দোলন এর আগে এতোটা গবফরধ পড়াবত্ধমব পায়নি, যতটা পেয়েছে এখন। সারাদেশের মানুষ অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছেন, এখানে ছাত্রীরাও নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং তাদের উপস্থিতি ছিল অভাবনীয়। তারাও স্লোগানে স্লোগানে এগিয়ে নিয়েছেন আন্দোলনকে। সুতরাং এখানে কোনো রাজনীতি নয়, বরং নিজেদের প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচানোর জন্যই তারা আন্দোলন করছেন। আপনারা এবং আপনাদের পোষা লোকজনই এ আন্দোলনকে রাজনীতিকরণ করছেন। শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো খুবই সুস্পষ্ট। শিক্ষার্থীদের প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ 
১.২৭(৪) ধারা বাতিলকরণ, যা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বিষফোঁড়ার মতো। এখানে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট মেয়াদের পর, বিশ্ববিদ্যালয় কোনো সরকারি অনুদান পাবে না। সে অনুসারে ২০১৩ সালে সরকারি অনুদান বন্ধ হয়ে যাবে। নিজেদের অর্থায়নে চলতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়কে, যা একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে কোনো যুক্তিতেই মেনে নেয়া যায় না। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মানে হলো সেটি পুরোপুরি সরকারি অর্থায়নে চলবে।
২. হল নির্মাণ। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম শর্ত হলো হল থাকা। আবাসিক হল ছাড়া একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায় না। এই হল থেকেও বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা। হল না থাকায় আমরা মানবেতর জীবনযাপন করি, যা কারও মাথাব্যথার কারণ হয় না। হলের অভাবে আমাদের অধিকাংশকে থাকতে হয় বস্তিতে। যেখানে থাকে না কোনো পড়াশোনার পরিবেশ, থাকে না নিরাপদ স্বাস্থ্য। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর রাতযাপন করতে হয়, দিন কাটাতে হয় একজন রিকশাচালক, ট্যাক্সিচালকের সঙ্গে, যা সত্যিই দুঃখজনক। এর অর্থ এই নয় যে, রিকশাচালক নিম্নমানের মানুষ বলে তাদের ঘৃণার চোখে দেখছি; বরং রিকশাচালক এবং শিক্ষার্থীর পরিবেশগত পার্থক্যই আমি নির্দেশ করছি। হলের অভাবে এভাবে শিক্ষার্থীদের কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ বা গাবতলীতে থাকতে হয়। ট্রাফিক জ্যামের শহরে গাবতলী-নারায়ণগঞ্জ থেকে জগন্নাথে এসে ক্লাস করা কতোটা কষ্টকর, কতোটা যন্ত্রণাদায়ক, কতোটা সময়ের অপচয় তা বাস্তবতা ছাড়া বোঝানো অসম্ভব। যদি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সাক্ষাত্কার নেয়া হয় তাহলে একই চিত্র ফুঠে উঠবে সবার মুখ থেকে। যা সত্যই সবাইকে বেদনাহত করে। শুধু একজন শিক্ষার্থীর জীবন কাহিনীই আপনাদের সামনে পেশ করবো আজ। নাম তার আতিক রায়হান (ছদ্মনাম)। তিনি থাকেন কেরানীগঞ্জে একটি মেসে। তার রুমে ৪ জন সদস্য। তিনিই একমাত্র ছাত্র। বাকি ৩ জনের ২ জন রিকশাচালক, একজন স্যানেটারি মিস্ত্রি । এ পুরো মেসের সব বাসিন্দাই শ্রমিক। গোসল করার মতো চাপকল আছে, যা সপ্তাহের ৪ দিনই অকেজো থাকে। গোসল করতে হয় দুর্গন্ধময় পচাগলা বুড়িগঙ্গায়। টয়লেট নোংরা, লেগে থাকে সিরিয়াল। প্রশ্ন করায় তিনি জানালেন, ভাড়া কম তাই এসব সহ্য করেই এভাবে থাকতে হয়। ভাড়া কতো জানতে চাইলে তিনি বলেন ২৬০ টাকা। এই হলো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে আসা একজন শিক্ষার্থীর মানবেতর জীবনগাথা। এখানে নামটি ছাড়া সব বর্ণনা সত্য। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, এগুলো রূপকথা নয়। জগন্নাথে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বাস্তবতা। যারা দুগ্ধফেনিল শয্যায় ঘুমান তারা এগুলোর কী বুঝবেন! শিক্ষার্থীরা দুগ্ধফেনিল শয্যা চাচ্ছেন না, তার চাচ্ছেন শিক্ষার একটি সুষ্ঠু পরিবেশ। যেখানে তাদের মননশীলতা বাড়ে, সৃজনশীলতা অর্জিত হয়।
ছাত্রলীগ ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের ভূমিকায়
একটি স্কুল, একটি কলেজ এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্ব থাকে। যে নেতা বা নেত্রীর প্রধানতম এবং সর্বপ্রথম দায়িত্ব হলো সে যেখানে অধ্যয়নরত সে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখা। সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা করতে সচেষ্ট হওয়া। কিন্তু ভুল করে মনে হয়, এ চিত্রটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এখানে রয়েছে লেজুড়বৃত্তিক শিক্ষার্থী, রাজনীতি। তারা মনে করেন আগে দল তারপর দেশ, জাতি, প্রতিষ্ঠান। তাদের ধারণা, দল না থাকলে দেশ, জাতি এবং প্রতিষ্ঠান দিয়ে কী হবে! বড়ই চমত্কার আমাদের রাজনীতি ভাবনা! এ মুহূর্তে মনে করতে হয় বিশ্বখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক মেরি শেলির (১৭৯৭-১৮৬১) উপন্যাসের ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সেই দানবের কথা, যে দানব স্বজাতিকে হত্যা করে আর্কটিক সাগরের দিকে পালিয়ে যায়। এবং কিছু কাল পর স্রষ্টা ভিক্টরকে হত্যার পর নিজেও আত্মহত্যা করে।
এ প্রসঙ্গ এজন্যই অবতারণা করা হলো, যখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন তাদের নিজেদের স্বার্থে, ঠিক তখনই ছাত্রলীগের নেতারা শিক্ষার্থীদের মিছিল থেকে ধরে নিয়ে যায়, বেধড়ক পেটায় এবং শিবির বলে পাঠিয়ে দেয় থানায়। এ চিত্র জাতি প্রত্যক্ষ করেছে বিভিন্ন মিডিয়ার বদৌলতে। হুমকি দেয়া হয়েছে আন্দোলনে না যাওয়ার জন্য। চক্রান্ত হয়েছে নানাভাবে আন্দোলন দমনের জন্য। কিন্তু তারা সফল হতে পারেননি। দমন করতে না গিয়ে তাদের উচিত ছিল সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে শিক্ষার্থীদের স্বার্থরক্ষায় এগিয়ে আসা। তা না করে করেছেন উল্টোটা। শিক্ষার্থীরা মিছিল বের করলে তারাও ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে পাল্টা মিছিল বের করেছেন। যা সত্যিই সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। এজন্যই তারা নেতাদের কোনো বাধা-হুমকি পরোয়া না করে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, যা এখনও চলমান এবং দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে ।
সুতরাং আমি এখানে এটাই বলতে চাই, দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি ছাত্র সংগঠনের উচিত আগে তার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের স্বার্থ দেখা, তারপর দলের চিন্তা করা। এটা যদি হয় তাহলেই কেবল শিক্ষার্থী-রাজনীতির সুফল বয়ে আসবে, নচেত্ নয়। তাই আমাদের স্লোগান হওয়া উচিত—‘আগে দল নয়, আগে প্রতিষ্ঠান হয়’। মনে রাখা উচিত আমরা যেন কেউ ভিক্টর সৃষ্ট ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব না হই, যে তার স্বজাতিকে খুন করে।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
mahfuzjnu21@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.