ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে নরসিংদী by মাজহারুল পারভেজ মন্টি,

রসিংদী পৌর মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা লোকমান হোসেন হত্যার প্রতিবাদে নরসিংদীতে তাণ্ডব চালিয়েছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও দলটির অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। মঙ্গলবার রাতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে লোকমান নিহত হওয়ার প্রতিবাদে আহূত ছাত্রলীগের হরতাল চলাকালে আন্তঃনগর এগারসিন্দুর এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন, মহাসড়কে ভাংচুর, অবরোধসহ ব্যাপক সহিংস ঘটনা ঘটে। আগুনে ট্রেনের ১৩টি বগির মধ্যে ১১টি ভস্মীভূত হয়েছে। আহত হয়েছেন প্রায় অর্ধশত ট্রেনযাত্রী। সরকারি দলের এই তাণ্ডবে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কেও যান চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয় হরতালকারীরা।


এতে আসন্ন ঈদ উদযাপনের জন্য ঘরমুখো মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার হয়। ট্রেন-বাস থেকে নেমে যাত্রীদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বিকল্প যানবাহন খুঁজতে দেখা যায়। কয়েক ঘণ্টা পর যানচলাচল শুরু হলেও দীর্ঘ যানজটে ভোগান্তি ছিল অন্তহীন।
নরসিংদী রেলস্টেশনের মাস্টার মরণ চন্দ্র দাস জানিয়েছেন, গতকাল সকাল সোয়া ১০টার দিকে ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জগামী আন্তঃনগর এগারসিন্দুর ট্রেনটি শহরের চিনিশপুর পৌঁছানোর পর হরতালকারীরা আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে ১১টি বগি পুড়ে গেছে। তিনি জানান, বগি থেকে বের হতে গিয়ে অনেক যাত্রী কম-বেশি আহত হন। পরে নরসিংদী ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা দীর্ঘ সময় চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে র্যাব টহল দল ঘটনাস্থলে গেলে বিক্ষুব্ধরা তাদের গাড়ির দিকেও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে।
মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে শহরের সদর রোডে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে মুখোশধারীদের গুলিতে গুরুতর আহত
হন লোকমান। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় রাত ১১টার দিকে তার মৃত্যু হয়। টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর সঙ্গে তীব্র দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন পৌর মেয়র লোকমান। এ নৃশংস হত্যার ঘটনায় স্থানীয়রা আঙুল তুলছেন মন্ত্রীর দিকে। যদিও বিএনপির শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক ও নরসিংদী জেলা বিএনপি সভাপতি খায়রুল কবীর খোকনকে গভীর রাতে ডিবি পুলিশ তার ঢাকার খিলগাঁওর বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। ডিবি অফিসে জিজ্ঞাসাবাদের পর খোকনকে নরসিংদী কারাগারে নেয়া হয়েছে বলে সরকারি সূত্র জানিয়েছে। খায়রুল কবীর খোকনের স্ত্রী মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদিকা শিরিন সুলতানা অভিযোগ করেছেন, গুলিবিদ্ধ নরসিংদীর মেয়র লোকমানকে হাসপাতালে দেখে বাসায় এসে ঘুমানোর পর কোনো মামলা ও ওয়ারেন্ট ছাড়াই ডিবি পুলিশ খোকনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। বিএনপির পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দলীয় ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে মেয়র লোকমান খুন হয়েছেন বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে। এদিকে গতকাল বিকালে নরসিংদী স্টেডিয়ামে জানাজা শুরুর আগে নিহতের ভাই নরসিংদী সরকারি কলেজের ভিপি ও জেলা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজ এবং জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি কামরুজ্জামান বলেন, আমরা এবং আমাদের পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় আছি। কে বা কারা লোকমান হোসেনকে হত্যা করেছে ও হত্যার ইন্ধন দিয়েছে—তা সবার কাছে পরিষ্কার।
এ সময় তারা আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, আমরা কার কাছে বিচার চাইব। নরসিংদীর জনগণই আমাদের শক্তি। তাদের কাছেই লোকমান হোসেন হত্যার বিচারের ভার রইল। এরপরও প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের ভাই হত্যার বিচার দাবি করছি। জানাজায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা অংশগ্রহণ করেন।
পৌর মেয়র লোকমান গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর মঙ্গলবার রাতেই সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা নরসিংদী সার্কিট হাউস এবং রেলস্টেশনে ব্যাপক ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। তারা ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে রাখে। গতকাল সকালে ট্রেন চলাচল আবার শুরু হলেও এগারসিন্দুরে আগুন দেয়ার পর ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-কিশোরগঞ্জ ও ঢাকা-সিলেট রুটে রেল যোগাযোগ আবার বন্ধ হয়ে যায়।
নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক লোকমানকে হত্যার প্রতিবাদে রাতেই ৭২ ঘণ্টার হরতাল ডাকে জেলা ছাত্রলীগ। ভয়ে-আতঙ্কে নরসিংদী শহরের সব দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সকাল থেকে বন্ধ থাকে। রিকশা ছাড়া শহরে অন্য কোনো যানবাহন চলেনি।
হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবিতে সকালে শহরের বিভিন্ন সড়কে বিক্ষোভ মিছিল করে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। বিক্ষুব্ধ জনতা ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে।
গতকাল সকাল থেকে ৭২ ঘণ্টার হরতাল শুরু হলেও লোকমানের জানাজা ও দাফনের বিষয়টি মাথায় রেখে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কর্মসূচি শিথিল করা হয়েছে। বিকালে নরসিংদী স্টেডিয়ামে লোকমান হোসেনের জানাজায় মানুষের ঢল নামে। পরে তার প্রতিষ্ঠিত কবরস্থানেই তাকে দাফন করা হয়।
তার আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে দুপুরে লোকমানের লাশ নরসিংদীতে পৌঁছলে তাকে দেখতে শহরের হাজারো মানুষ সেখানে জড়ো হয়। লোকমানদের বাড়িতে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
নরসিংদীর পুলিশ সুপার আক্কাছ উদ্দিন ভূঁইয়া জানান, সহিংস ঘটনা মোকাবিলায় আশপাশের জেলাগুলো থেকে বিপুলসংখ্যাক পুলিশ ও র্যাব সদস্য নরসিংদী শহরে মোতায়েন করা হয়েছে। হত্যাকারীদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে বলেও জানান তিনি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বেলা সাড়ে ১১টায় নিহত লোকমান হোসেনের লাশ নরসিংদীতে তার বাড়িতে নেয়া হয়। তার জানাজার জন্য জেলা ছাত্রলীগের ডাকা ৭২ ঘণ্টার হরতাল সকাল ১০টায় ছয় ঘণ্টার জন্য শিথিল করা হয়। এর আগে ভোর ৬টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত জেলায় হরতাল পালিত হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, লোকমান সমর্থক ও ছাত্রলীগের কর্মীরা সকাল সোয়া ১০টায় শহরের চিনিশপুরে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা এগারসিন্দুর ট্রেনটিতে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এতে কমপক্ষে ৪০-৫০ জন আহত হয়। কয়েকশ’ শ্রমিক ও হরতাল সমর্থকরা ট্রেনলাইনের ওপর গাছের গুঁড়ি ফেলে ট্রেনটি থামায়। এরপর ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। আগুনে ট্রেনের ১১টি বগি পুড়ে গেছে। পরে নরসিংদী ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সাড়ে ১১টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। কিন্তু ওই রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সকাল সাড়ে ৬টায় শহরের পশ্চিম কান্দাপাড়া এলাকায় জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে শত শত মানুষের জটলা। সকাল ৭টায় বাসাইল এলাকায় নিহত লোকমান হোসেনের বাসভবনে গিয়ে দেখা যায়, হাজার হাজার কর্মী, সমর্থক ও এলাকাবাসী তার বাড়িতে ভিড় জমিয়েছে। বিক্ষুব্ধ জনতা ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে টায়ার ও গাছের গুঁড়ি জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে। পুরো শহরের প্রতিটি মোড়ে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তবে সরকারি দলের কর্মীদের তাণ্ডবের সময় পুলিশ-র্যাব ছিল নীরব দর্শক।
জানাজা : নরসিংদী পৌরসভার নিহত মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতা লোকমান হোসেনের জানাজা বিকাল ৫টায় নরসিংদীর মোসলেমউদ্দিন ভুইয়া স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার বিপুলসংখ্যক মানুষ এ জানাজায় অংশ নেয়। পৌর ঈদগাহ মাঠে দ্বিতীয় জানাজা শেষে মেয়রের নির্মিত পৌর কবরস্থানেই তাকে দাফন করা হয়েছে।
এর আগে বিকাল ৩টা ৪০ মিনিটে নিহতের লাশ তার বাসা থেকে স্টেডিয়ামে আনা হয়। সেখানে তার রুহের মাগফিরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জেলা নেতা, সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তা ও নিহতের স্বজনরা।
উপস্থিত নেতাদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, বাহাউদ্দিন নাসিম, সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু, আনোয়ারুল হক দিলীপ, ওবায়দুল হক মহল, নুরুল মাহমুদ হুমায়ুন, নজরুল ইসলাম হিরু, টঙ্গী পৌরসভার মেয়র আজমতউল্লাহ খান, নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান প্রমুখ।
আট ঘণ্টা পর ট্রেন চালু : নরসিংদীতে এগারসিন্দুর ট্রেনে আগুন দেয়া ও অবরোধের কারণে বন্ধ হওয়ার দীর্ঘ ৮ ঘণ্টা পর গতকাল রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। তবে অন্তত ৭টি ট্রেনের যাত্রা বাতিল করতে হয়েছে। অন্যান্য ট্রেন বিভিন্ন স্থানে আটকে পড়ে।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানায়, ঢাকা ও চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া চারটি আন্তঃনগর ট্রেনসহ আটটি ট্রেন বিভিন্ন জায়গায় আটকে পড়ে। ফলে ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
এদিকে ট্রেন ছাড়া নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকায় পাঁচটি মেইল ট্রেনের যাত্রা বাতিল করে কর্তৃপক্ষ। চিফ ট্রেন কন্ট্রোলার সাহাবুদ্দিন জানান, সকাল সোয়া ১০টার পর নরসিংদীর ওপর দিয়ে কোনো ট্রেন চলাচল করতে দেয়নি বিক্ষোভকারীরা। বিকাল ৩টায় আগুনে পুড়িয়ে দেয়া এগারসিন্দুর এক্সপ্রেস ট্রেনটি আরেকটি ইঞ্জিন দিয়ে ঘোড়াশাল সাবস্টেশনে নিয়ে যাওয়ার পর লাইন ক্লিয়ার হয়। এরপর ভৈরববাজারে আটকে পড়া ঢাকাগামী সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনটি চালু করা হয়। কিন্তু কিছুদূর গিয়ে আমীরগঞ্জে পৌঁছার পর আবার সেটি আটকে দেয় স্থানীয়রা। ৮ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় সব ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে বলে জানান তিনি।
যে কারণে এ নারকীয় হত্যাকাণ্ড : প্রচণ্ড জনপ্রিয়তার কারণেই অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে জননন্দিত এই নেতাকে। দলীয় নেতাকর্মী, সমর্থক ও জেলাবাসী সবাই একই সুরে বলেছেন এ কথা। জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক থেকে সাধারণ সম্পাদক, পরে শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং নরসিংদী পৌরসভার মেয়র। আর প্রথমবার মেয়র হয়েই মেধাবী এই মানুষটি দক্ষতার সঙ্গে নরসিংদী পৌরসভার অভূতপূর্ব উন্নয়নসাধন করেছেন। স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার তাকে পরপর দু’বার দেশের শ্রেষ্ঠ মেয়র হিসেবে স্বর্ণপদক প্রদান করেন। পরে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের দ্বিতীয় দফায় বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হন।
সদালাপি মেয়র লোকমান হোসেন জেলার অনেক সিনিয়র নেতাকে টপকে নরসিংদীতে জননন্দিত নেতায় পরিণত হন। অনেকেরই অভিযোগ, এতে বিরাগভাজন হয়ে পড়েন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজি উদ্দিন আহমেদ রাজু এবং তার ছোট ভাই সালাউদ্দিন বাচ্চুসহ বেশকিছু সিনিয়র নেতা। আর সে কারণেই তাকে অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে বলে দাবি করেন নিহতের স্বজন ও পৌরবাসী।

No comments

Powered by Blogger.