ভোগান্তির মধ্যে ঈদযাত্রা শুরু : ঢাকার সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের রেল যোগাযোগ বিঘ্নিত : মেরামত ও অব্যবস্থাপনায় রাস্তায় দীর্ঘ যানজট by কাজী জেবেল

বিত্র ঈদুল আজহার বাকি মাত্র ৪ দিন। স্বজনদের সঙ্গে এই ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে রাজধানী ছাড়তে শুরু করেছেন ঘরমুখো মানুষ। গতকাল বাস, ট্রেন ও লঞ্চে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক বেশি যাত্রী গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। এসব যাত্রীর বেশিরভাগই পথে চরম ভোগান্তির শিকার হন। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা তীব্র কষ্ট ভোগ করেন। নরসিংদীর বাসাইলে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা ট্রেনে আগুন দিলে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দিগ্বিদিক ছুটে পালায় অনেক যাত্রী। এ ঘটনায় ঢাকার সঙ্গে ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ পূর্বাঞ্চলীয় রুটে রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।


এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ট্রেন কখন চালু হবে তা সুনির্দিষ্ট করে জানাতে পারেনি রেলওয়ের পরিচালক (ট্রাফিক) সরদার সাহাদাত আলী। ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় কমলাপুর, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ সংশ্লিষ্ট স্টেশনগুলোতে হাজার হাজার যাত্রী ট্রেনের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন। এছাড়া রাস্তা মেরামত ও বিকল ট্রাক দ্রুত সরিয়ে ফেলতে ব্যর্থ হওয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রায় ৫০ কিলোমিটারব্যাপী যানজটের সৃষ্টি হয়। এসব স্থানে খাবার ও পানি সঙ্কট দেখা দিয়েছে। লঞ্চ মালিকরা অভিযোগ করেছেন, নাব্য সঙ্কটের কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে কম গতিতে লঞ্চ চালাতে হচ্ছে। এতে অতিরিক্ত সময় ব্যয় হচ্ছে। যাত্রীরা আতঙ্ক ও কষ্টে রয়েছে।
এদিকে ঈদ উপলক্ষে বিআরটিসি’র দুই শতাধিক বাস, বিআইডব্লিউটিসি’র স্টিমার ও সি-ট্রাক এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন বাস কোম্পানি গতকাল থেকে স্পেশাল সার্ভিস চালু করেছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের স্পেশাল সার্ভিস আগামীকাল থেকে চালু করবে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানায়, ঈদ উপলক্ষে ১৩১টি কোচ ও ৫টি নতুন ইঞ্জিন সংযোজন করা হয়েছে। ট্রেন প্রতিদিন ৩৫ হাজার যাত্রী বহন করবে। টিকিট ছাড়া দাঁড়িয়েও যাত্রী নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে বসা ও দাঁড়িয়ে থাকা উভয় যাত্রীর কষ্ট হলেও ঘরমুখো মানুষ বাড়ি ফিরতে পারবেন—এমন চিন্তা করে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলেও জানায় কর্তৃপক্ষ। নৌপথে দক্ষিণাঞ্চলগামী মানুষের ভরসা লঞ্চ আজ থেকে ঈদ স্পেশাল সার্ভিস চালু করবে। লঞ্চ মালিক সমিতির সহ-সভাপতি শহীদ ভূইয়া জানান, ঢাকা নৌবন্দর (সদরঘাট) থেকে চলাচলকারী ৩৮টি রুটে আজ থেকে স্পেশাল সার্ভিস চালু হবে। আজ থেকে লঞ্চ ছাড়ার নির্দিষ্ট কোনো সময় নির্ধারিত থাকবে না। নাব্য সঙ্কট থাকায় লঞ্চগুলো পর্যাপ্ত যাত্রী পেলেই গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে।
ঈদে নির্বিঘ্নে যাত্রী পারাপার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান মো. শামসুদ্দোহা খন্দকার গতকাল আমার দেশ-কে বলেন, সুষ্ঠুভাবে যাত্রী পরিবহনে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যেসব নদীতে নাব্য সঙ্কট রয়েছে, তা দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। মাওয়া-চরজানাজাত এলাকায় ৮টি, পাটুরিয়া দৌলতদিয়া ৭টি এবং ঢাকা-বরিশাল রুটে ১টি ড্রেজার দিয়ে নাব্য সঙ্কট দূর করার কাজ চলছে। আশা করি, ঈদে যাত্রীদের কোনো সমস্যা হবে না।
শুরুতেই ভোগান্তি : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে সারারাত অপেক্ষা করে গত ২৭ অক্টোবর যেসব যাত্রী ঈদের আগাম টিকিট সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন, তারাই গতকাল গন্তব্যে রওনা করেন। কিন্তু বিধি বাম! গতকাল সকালে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়া এগারোসিন্দুর ট্রেনে আগুন লাগিয়ে দেয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। এ সময় আতঙ্কিত যাত্রীরা ব্যাগ-লাগেজ নিয়ে ছুটোছুটি-হুড়োহুড়ি শুরু করেন। এ সময় সেখানে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। ট্রেন চলাচল শুরুতে অনিশ্চয়তা দেখে বেশিরভাগ যাত্রীকে পায়ে হেঁটে, রিকশা-ভ্যানে চড়ে ও বিকল্প পথে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে।
এদিকে অন্যান্য ঈদের মতো এবারও সড়কপথে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জে একটি পণ্যবাহী ট্রাক বিকল হয়ে পড়ায় এবং দাউদাকান্দি মহাসড়কে মেরামতকাজ চলায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৫০ কিলোমিটারব্যাপী যানজটের সৃষ্টি হয়। এ সময় যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসে অপেক্ষা করতে হয়েছে। বেড়েছে ভোগান্তি। গাড়ি চালকরা জানান, ইলিয়টগঞ্জ থেকে গৌরিপুর যেতে ৩-৪ ঘণ্টা সময় লেগেছে। দীর্ঘ সময় যানজটের কারণে সবচেয়ে অসুবিধায় পড়েছেন অ্যাম্বুলেন্সে থাকা রোগী ও বিদেশগামী যাত্রীরা।
এখনও কালোবাজারে টিকিটের সন্ধানে : পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, অন্য সময়ের তুলনায় গতকাল বাস, লঞ্চ ও ট্রেনে যাত্রীদের চাপ বেশি ছিল। এসব যাত্রীর বেশিরভাগই নারী ও শিশু। লঞ্চ ও বাসের আগাম টিকিট অনেক আগেই বিক্রি হয়ে যায়। ট্রেনের টিকিট বিক্রি শেষ হয়েছে গত ৩১ অক্টোবর সোমবার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে যারা আগাম টিকিট সংগ্রহ করেছেন, তারাই গতকাল যাত্রা শুরু করেছেন। আজ অফিস শেষে যাত্রীদের প্রধান চাপ পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ হিসেবে তারা জানান, ঈদুল আজহার তিন দিনের সরকারি ছুটি শুরু হবে রোববার থেকে। এর আগে শুক্র ও শনিবার রয়েছে সাপ্তাহিক ছুটি। এর ফলে শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা শুরু হবে। এজন্য বাস, ট্রেন ও লঞ্চ অতিরিক্ত ট্রিপের ব্যবস্থা করেছে। গতকাল রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলো ঘুরে দেখা গেছে, অনেক আগেই ঈদের আগাম টিকিট বিক্রি শেষ হয়ে গেছে। শেষ সময়ে এখনও অনেক যাত্রী টিকিটের জন্য ঘোরাঘুরি করেছেন। অনেকে আবার কালোবাজারিদের কাছ থেকে অতিরিক্ত দামে টিকিট কেনার চেষ্টা করছেন। আবার কেউ কেউ এখনও কাউন্টারে আগাম টিকিটের জন্য চেষ্টা করছেন। সূত্র জানায়, মহাখালী ও সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া কিছু বাস কোম্পানির টিকিট এখন পাওয়া যাচ্ছে। তবে আদায় করা হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে টিকিট বিক্রেতাদের যুক্তি—সরকার-নির্ধারিত হারে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। ফেরার সময় খালি গাড়ি নিয়ে আসতে হয় বলে তার কিছুটা যাত্রীদের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে। যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টিকিটপ্রতি ৩০-১০০ টাকা পর্যন্ত বেশি আদায় করা হচ্ছে।
বিআরটিসি ও বিআইডব্লিউটিসি’র ঈদ স্পেশাল : ঈদে বাড়তি যাত্রী পরিবহনে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন (বিআরটিসি) ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) ঈদ স্পেশাল সার্ভিস চালু করেছে। বিআরটিসি’র ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশনস) মেজর কাজী শফিক উদ্দিন আমার দেশ-কে জানান, ঢাকা থেকে ২০ জেলা ও ৭ উপজেলা এবং সারাদেশে ৪৬ জেলায় ঈদ সার্ভিস পরিচালনা করা হবে। এর মধ্যে ঢাকা থেকে ১৫০টি ও সারাদেশে ৩০০টি অতিরিক্ত বাস চলাচল করবে। প্রয়োজনে বাসের সংখ্যা বাড়ানো হবে। তিনি আরও জানান, গতকাল থেকে ঈদ সার্ভিস শুরু হয়েছে। ঈদের পর যতদিন যাত্রী পাওয়া যাবে ততদিন এ সার্ভিস চালু থাকবে। এছাড়া বিআইডব্লিউটিসি গতকাল থেকে বিশেষ সার্ভিস চালু করেছে। ঈদের পর আগামী ১২ নভেম্বর পর্যন্ত এ সার্ভিস চালু রাখবে। বিআইডব্লিউটিসি ঘোষিত শিডিউল অনুযায়ী, গতকাল দুটি, আজ তিনটি, ৪ নভেম্বর তিনটি, ৫ নভেম্বর তিনটি ও ৬ নভেম্বর দুটি স্টিমার ঢাকা থেকে বরিশাল-ঝালকাঠী-পিরোজপুর- মোরেলগঞ্জের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। আবার ঈদের পর ৮ নভেম্বর দুটি, ৯ নভেম্বর একটি, ১০ নভেম্বর দুটি, ১১ নভেম্বর একটি, ১২ নভেম্বর দুটি ও ১৩ থেকে ১৫ নভেম্বর একটি করে স্টিমার মোরেলগঞ্জ-বরিশাল হয়ে ঢাকায় আসবে।
লঞ্চের স্পেশাল ট্রিপ আজ থেকে : রোটেশন প্রথা ভেঙে আজ থেকে সবগুলো লঞ্চ চলাচলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে লঞ্চ মালিক সমিতি। সংগঠনের সহ-সভাপতি শহীদ ভূইয়া গতকাল আমার দেশ-কে বলেন, নিয়মিত ও স্পেশাল লঞ্চগুলোর কোনো নির্ধারিত সময় থাকবে না। লঞ্চে যাত্রী ভরে গেলেই তারা তা ছেড়ে দেবে। তিনি আরও জানান, প্রতিটি রুটে অতিরিক্ত লঞ্চ চলাচল করবে। এসব লঞ্চযাত্রীকে গন্তব্যে নামিয়ে দিয়ে খালি অবস্থায় ঢাকায় চলে আসবে, আবার ট্রিপ দেবে। এদিকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরবিহন (যা-প) সংস্থার সিনিয়র সহ-সভাপতি বদিউজ্জামান বাদল জানান, ঢাকা প্রান্ত থেকে ৩-৬ নভেম্বর পর্যন্ত—চার দিন এবং ঈদের পর ৯-১৭ নভেম্বর পর্যন্ত দক্ষিণাঞ্চলের রুটগুলো থেকে ঢাকাগামী লঞ্চের স্পেশাল সার্ভিস চলবে।

No comments

Powered by Blogger.