মেসির ২০০ গোলের আদ্যন্ত by রাহেনুর ইসলাম

প্রতিভা তার জাত আলাদা করে চেনাবেই। আর পাঁচজনের থেকে আলাদা বলেই না প্রতিভা! তার বিচ্ছুরণ না হয়ে পারে? পারে না বলেই প্রায় প্রতিটি ম্যাচে ২২ জনের মধ্যে নিজেকে আলাদা করে মেলে ধরেন লিওনেল মেসি।গত চার বছর বার্সেলোনার জার্সি গায়ে এমন গ্রহান্তরের ফুটবল খেলেছেন যে মাঝেমধ্যে মনে হয়, ফুটবল নয়, জাদুবিদ্যাই চলছে যেন। অবিশ্বাস্য সব গোল। কল্পনাকে তাক লাগানো ড্রিবল। গভীর কল্পনাশক্তিতে ডিফেন্সচেরা পাস। গোলে মাপা চিপ, কখনো কখনো ঝড়োগতির শট। চমকে যায় প্রতিপক্ষও। মোহিত হয় সবাই।


পুরো ফুটবল বিশ্বকে মোহিত করেই অনন্য এক মাইলফলকে নাম লেখালেন আর্জেন্টাইন খুদে জাদুকর। মাত্র ২৪ বছর ১৩০ দিনে বার্সেলোনার জার্সিতে করলেন ২০২ গোল। তা-ও পরপর দুটো হ্যাটট্রিক করে। বুঝতেই পারছেন গোলের ক্ষুধাটা কেমন নায়াগ্রা জলপ্রপাত হয়ে ঝরছে। শেষ নেই, শেষ নেই। এই বয়সে গোলের ডবল সেঞ্চুরি হলে কিছু রেকর্ড অবধারিতভাবেই হয়ে যায়। হয়েছে মেসির বেলায়ও। তিনি এখন বার্সেলোনার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা। ২৩৫ গোল নিয়ে সামনে কেবল সিজার রদ্রিগেজ। যে গতিতে এগোচ্ছেন তাতে না এই মৌসুমেই রদ্রিগেজকে পেছনে ফেলে দেন সময়ের সেরা এই ফুটবলার।
২০২ গোলের মধ্যে স্প্যানিশ লিগে ১৩২, কোপা দেল রে'তে ১৭, স্প্যানিশ সুপার কাপে ৮, চ্যাম্পিয়নস লিগে ৪২, ক্লাব বিশ্বকাপে ২, আর ১টি গোল করেছেন ইউরোপিয়ান সুপার কাপে। সোনালি বাঁ পায়ে করেছেন সবচেয়ে বেশি ১৫৬ গোল। ডান পায়ে ৩৬ আর হেডে গোল আছে ৮টি, যার একটি ২০০৮-০৯ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে। ডিয়েগো ম্যারাডোনার মতো হাত দিয়ে একটি আর বুক দিয়েও আছে ১ গোল। হাত দিয়ে গোলটি করেছিলেন ২০০৭ সালে এসপানিয়লের বিপক্ষে। আর বুক দিয়ে ২০০৯ সালে ক্লাব বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টাইন ক্লাব এসতুদিয়ান্তেসের বিপক্ষে।
গত তিন-চার বছরে মেসি গোলের যে ঝরনাধারা বইয়ে দিচ্ছেন সেটা কিন্তু ছিল না ক্যারিয়ারের শুরুতে। প্রথম চার মৌসুমে কখনোই করতে পারেননি ২০ গোল। মাঝমাঠের অনিয়মিত একজন প্লে-মেকারের সেটা না পারাই স্বাভাবিক। তবে ফ্রাংক রাইকার্ডের শেষ মৌসুমে নিয়মিত হওয়ার পর তিনি মেলে ধরেন নিজেকে। আর ২০০৭-০৮ মৌসুমে বার্সার দায়িত্ব নিয়ে পেপ গার্দিওলা ক্লাব ছেড়ে যাওয়া রোনালদিনহোর ১০ নম্বর জার্সিটা মেসিকে দেওয়ার পর হয়ে ওঠেন গোলরক্ষকদের আতঙ্ক। তাতেই এই বয়সে পেয়ে গেলেন গোলের ডবল সেঞ্চুরিও।
বার্সেলোনায় যোগ দিয়েছিলেন ১৩ বছর বয়সে। এখানকার একাডেমীতে গড়ে উঠতে উঠতে খেলেছেন চাইল্ড-এ, ক্যাডেট-বি, ক্যাডেট-এ, জুনিয়র-এ, বার্সা-সি, বার্সা-বিতে। আর বার্সার মূল দলে অভিষেক ১৭ বছর ১১৪ দিনে ২০০৪ সালের ১৬ অক্টোবর এসপানিয়লের বিপক্ষে। এটা ছিল সে সময়ে লা লিগায় সবচেয়ে কম বয়সে খেলার রেকর্ড, যা পরে ভাঙেন বোজান কিরকিচ। প্রথম গোল অ্যালবাস্তে বালোমপাইয়ের বিপক্ষে ২০০৫ সালের ১ মে। অর্থাৎ গোলের জন্য অপেক্ষা প্রায় ছয় মাসের। এর পরও ১৭ বছর ১০ মাস সাত দিনে লক্ষ্যভেদ করাটা ছিল বার্সেলোনার হয়ে সবচেয়ে কম বয়সে গোলের কীর্তি। এ রেকর্ডটাও ২০০৭ সালে ভাঙেন কিরকিচ।
বয়সে ছোট আর দলে অনিয়মিত থাকায় প্রথম চার মৌসুমে করতে পেরেছিলেন মাত্র ৪২ গোল। ২০০৪-০৫ মৌসুমে ৯ ম্যাচে ১, ২০০৫-০৬ মৌসুমে ২৫ ম্যাচে ৮, ২০০৬-০৭ মৌসুমে ৩৬ ম্যাচে ১৭ আর ২০০৭-০৮ মৌসুমে ৪০ ম্যাচে ১৬টি। রোনালদিনহো ক্লাব ছাড়ার পর গার্দিওলা ২০০৮-০৯ মৌসুমে ১০ নম্বর জার্সিটা দেন মেসিকে। সেই আস্থার প্রতিদান রেখে ফরোয়ার্ড হিসেবে ৫১ ম্যাচে করে বসেন ৩৮ গোল। অ্যাসিস্টও ছিল ১৮টি। এতগুলো গোল যেমন আগে কখনো করেননি মেসি তেমনি পারেননি এত বেশি অ্যাসিস্ট করতেও। অর্থাৎ প্লে-কার ও গোল স্কোরার হিসেবে সমান সফল ছিলেন সেই মৌসুমে। স্পেনের প্রথম দল হিসেবে সেবার চ্যাম্পিয়নস লিগ, লা লিগা ও কোপা দেল রের শিরোপা জিতে অনন্য ট্রেবল পূরণ করে বার্সেলোনা। সাফল্যের ভেলায় ভেসে ২০০৯-১০ মৌসুমে ৫৩ ম্যাচে ৪৭, ২০১০-১১ মৌসুমে ৫৫ ম্যাচে ৫৩ আর এই মৌসুমে এখন পর্যন্ত ১৭ ম্যাচে লক্ষ্যভেদ করেছেন ২২ বার।
বার্সেলোনার হয়ে ১০০তম গোলটা মেসি পান ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারি। সেভিয়ার বিপক্ষে সেই ম্যাচে ২ গোল করে পরিণত হয়েছিলেন বার্সার ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সী সেঞ্চুরিয়ানে। ১৮৮ ম্যাচে শততম গোলের সময় বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর ছয় মাস ২২ দিন। ওই বছরেরই নভেম্বরে ১৫০তম গোলটা করেছিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগে প্যানাথিনাইকোসের বিপক্ষে, যা ছিল আবার টানা ৯ ম্যাচে গোল করার অনন্য কীর্তি (ব্রাজিলের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ম্যাচের গোলটা ধরলে টানা ১০)। স্বপ্নের সেই যাত্রার সমাপ্তি ঘটে ২৯ নভেম্বর এল ক্লাসিকোয়। রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ৫-০ গোলে জিতলেও বিস্ময়করভাবে ম্যাচটিতে গোল পাননি মেসি। ডিফেন্ডাররা রক্ষণবূ্যহ গড়ে তোলায় যে ম্যাচে লক্ষ্যভেদ করতে পারেন না সেই ম্যাচে মেসির লক্ষ্য থাকে সতীর্থদের দিয়ে গোল করানোয়। রিয়ালের বিপক্ষে সেই এল ক্লাসিকোয় ২ গোল হয়েছে তাঁর পাস থেকেই।
২০০তম গোলটা পরশু অর্থাৎ ২০১১ সালের ১ নভেম্বর করলেন চ্যাম্পিয়নস লিগে ভিক্টোরিয়া প্লজেনের বিপক্ষে। পেনাল্টি থেকে প্রথম গোল করার পর উপলক্ষটা স্মরণীয় করেছেন আবার হ্যাটট্রিক করেই। ক্যারিয়ারে এটা ১৪তম হ্যাটট্রিক মেসির। চ্যাম্পিয়নস লিগের ৪২ গোলে মেসি করেছেন আবার সবচেয়ে কম বয়সে ৪০ গোলের রেকর্ডও। তাঁর আগে ২৫ বছর ২৫৮ দিনে ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদার এই আসরে ৪০ গোল করেছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের রাউল গনজালেস।
১৮৮ ম্যাচে সেঞ্চুরির পর ২০০তম গোলটা করলেন ২৮৬ ম্যাচে। অর্থাৎ পরের ১০০ গোল করতে খেলেছেন ৯৮ ম্যাচ। এমন রকেট গতিতে এগিয়ে চলেছেন বলে কেউ কেউ সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলারও বলছেন মেসিকে। সর্বকালের সেরা হতে যে বিশ্বকাপ জিততে হবে_সেটা ভালোই জানা মেসির। তবে এরই মধ্যে কিন্তু ২৪ বছর বয়সে গোলের বিচারে তিনি পেছনে ফেলেছেন অনেক কিংবদন্তিকে। মেসির বয়সে ডিয়েগো ম্যারাডোনার গোল ছিল ১৯৬টি। ১৯৭৭-৭৮ মৌসুম থেকে ১৯৮৪-৮৫ মৌসুমে আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স, বোকা জুনিয়র্স, বার্সেলোনা আর নাপোলির হয়ে খেলেছিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা এ ফুটবলার। ২৪ বছর বয়সে ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রোনালদো পিএসভি, বার্সেলোনা ও ইন্টার মিলানের জার্সিতে করেছিলেন ১৫৩টি গোল। ইংলিশ কিংবদন্তি ববি চার্লটন মেসির বয়সে করেছিলেন ১৩৩ আর জর্জ বেস্ট ১৭৯ গোল। পেলে বা ডি স্টেফানোরা এ সময় বেশ এগিয়ে ছিলেন মেসির চেয়ে। তবে আয়াঙ্রে হয়ে ২২৪ গোল করে মেসির কাছাকাছিই ছিলেন ডাচ কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রুইফ। মৌসুমটা শেষ হয়নি বলে এখনো ক্রুইফকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে মেসির। আর্জেন্টাইন খুদে জাদুকর পারেন কি না, সেটাই দেখার।

* সোনালি বাঁ পায়ে করেছেন সবচেয়ে বেশি ১৫৬ গোল। ডান পায়ে ৩৬ আর হেডে গোল আছে ৮টি। ডিয়েগো ম্যারাডোনার মতো হাত দিয়ে একটি আর বুক দিয়েও আছে ১ গোল।
* ২০২ গোলের মধ্যে স্প্যানিশ লিগে ১৩২, কোপা দেল রে'তে ১৭, স্প্যানিশ সুপার কাপে ৮, চ্যাম্পিয়নস লিগে ৪২, ক্লাব বিশ্বকাপে ২, আর ১টি গোল করেছেন ইউরোপিয়ান সুপার কাপে।
* বার্সেলোনার হয়ে ১০০তম গোলটা মেসি পান ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারি।
* ২০০তম গোলটা পরশু অর্থাৎ ২০১১ সালের ১ নভেম্বর করলেন চ্যাম্পিয়নস লিগে ভিক্টোরিয়া প্লজেনের বিপক্ষে।
* চ্যাম্পিয়নস লিগের ৪২ গোলে মেসি করেছেন আবার সবচেয়ে কম বয়সে ৪০ গোলের রেকর্ডও।
* মেসির বয়সে ডিয়েগো ম্যারাডোনার গোল ছিল ১৯৬টি। ব্রাজিলিয়ান রোনালদোর ১৫৩, জর্জ বেস্টের ১৭৯ ও ববি চার্লটনের ১৩৩টি।

No comments

Powered by Blogger.