প্রকল্প অনুমোদন দিতে মরিয়া সরকার মানা হচ্ছে না নিয়মনীতি by জাহিদুল ইসলাম

রকার চরম অর্থসঙ্কটে। এর মধ্যেও একটির পর একটি উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দিচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকায় ৬৪টি উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায় নেয়া বিতর্কিত প্রকল্পগুলোয়। অর্থবছরের শুরুতেই সারাবছরের বরাদ্দের তিনগুণের বেশি প্রকল্প অনুমোদন দেয়ায় অন্যান্য প্রকল্পের অর্থায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ফলে চলতি বছরের উন্নয়ন বাজেটের বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।


সরকারের পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, কমিশনের বিরোধিতা সত্ত্বেও শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। আর এসব প্রকল্প অনুমোদন দিতে কোনো নিয়মনীতিই মানা হচ্ছে না। প্যারিস ডিক্লারেশনসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন নীতিমালাও অবজ্ঞা করা হচ্ছে। জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের (একনেক) সভায় এসব প্রকল্প নিয়ে যথাযথ পর্যালোচনা করা হয় না। এসব প্রকল্পের বিরুদ্ধে কোনো কথা বললেই পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের ওএসডি করা হয়। আবার অনেক সময় দায়িত্ব থেকে দেয়া হয় অব্যাহতি।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের শুরুতে ৪৬ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন করে জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল (এনইসি)। এডিপি ঘোষণার পর থেকে একনেকের আটটি সভায় ১ লাখ ৫৩ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে ৮১ হাজার ৬৯ কোটি টাকা সরকারের তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে। আর ৩৮ হাজার ৬৯ কোটি টাকা প্রকল্প সাহায্য হিসেবে বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে জোগান দেয়া হবে।
প্রতিটি প্রকল্পের অনুকূলে চলতি অর্থবছরে নামমাত্র অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পরবর্তী বছরগুলোর জন্য এসব প্রকল্পে দেয়া হয়েছে বিপুল পরিমাণ বরাদ্দ। ফলে এসব প্রকল্পে অর্থায়ন করতে হলে সামনের বছরগুলোয় কয়েক লাখ কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট ঘোষণা করতে হবে।
এ সময়ে বেশক’টি বিতর্কিত ও রাজনৈতিক প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে সরকার। আবার বেশক’টি প্রকল্পের অনুমোদন প্রক্রিয়া ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকি নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে একনেকে উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে চলতি বছর।
চলতি বছরে অনুমোদন দেয়া বিতর্কিত প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় নেয়া একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক প্রকল্প, তৃতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প, গ্রামভিত্তিক সমবায় সমিতির মাধ্যমে কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধি ও গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্প, স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টিখাত উন্নয়ন কর্মসূচির তৃতীয় পর্যায় এবং তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর গ্রামীণ ডাকঘর নির্মাণ প্রকল্প। বহুল বিতর্কিত এসব প্রকল্পে সরকার বরাদ্দ দিয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা।
জানা যায়, প্রকল্প অনুমোদনে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা হয় একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পে। দুর্নীতি, অনিয়ম ও দলীয়করণের কারণে এর আগে বাতিল হয়ে যাওয়া এ প্রকল্পে ৩৯৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ দেয়ার আবেদন জানালে পরিকল্পনা কমিশন তা নাকচ করে দেয়। সমবায় বিভাগের কমিশনকে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করেও আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের এ প্রকল্পটির আওতা ও অর্থ বৃদ্ধি প্রস্তাবের অনুমোদন নিতে পারেনি। ১ হাজার ১৯৭ কোটি টাকার প্রকল্পে আরও ৫ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ পেতে মরিয়া হয়ে ওঠেন সমবায় বিভাগের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া সচিব ড. মিহির কান্তি মজুমদার। পরিকল্পনা কমিশনের সিদ্ধান্ত ‘ঈশ্বরের বাণী’ নয় মন্তব্য করে তা মানতে অস্বীকৃতি জানান তিনি।
রাজনৈতিক বিবেচনায় গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের বরাদ্দ চারগুণ বাড়ানো হয়েছে। শুরুতে এ প্রকল্পটির ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৬৩ কোটি টাকা। একটি ইটও স্থাপন করার আগেই এ প্রকল্পটির ব্যয় বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ২২০ কোটি টাকা। এ হিসাবে নির্মাণ কাজ শুরুর আগেই বঙ্গবন্ধুর নামে এ পার্কের ব্যয় বেড়ে গেছে ১৫৭ কোটি টাকা।
এদিকে ৪ হাজার ৫০১টি ইউনিয়ন পরিষদে তথ্যকেন্দ্র নির্মাণ করে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হলেও গ্রামীণ পোস্ট অফিসগুলোকে তথ্যকেন্দ্রে পরিণত করতে ১১২ কোটি ২৭ লাখ ৭০ হাজার টাকার প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এ অর্থ ব্যয় করে ১ হাজার গ্রামীণ পোস্ট অফিসকে উন্নত প্রযুক্তির তথ্যভাণ্ডার এবং ডিজিটাল ফটো স্টুডিওতে রূপান্তর করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ইউনিয়ন পরিষদ তথ্যকেন্দ্রের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন করার সাহস পাননি কেউ।
প্রকল্প অনুমোদন করবে স্টিয়ারিং কমিটি : স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্টিয়ারিং কমিটিকে প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষমতা দিয়ে অনুমোদন করা হয়েছে স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টিখাত উন্নয়ন কর্মসূচির তৃতীয় পর্যায়। এর আওতায় ২০ কোটি টাকা থেকে শুরু করে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দিতে পারবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে এ কমিটি। এর ফলে স্বাস্থ্যখাতের ৬৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের এ মহাপরিকল্পনার সফলতা ও আর্থিক স্বচ্ছতা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন জানায়, নিয়ম অনুযায়ী ২৫ কোটি টাকা বা এর বেশি প্রাক্কলিত ব্যয়সাপেক্ষ সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে একনেকের অনুমোদন প্রয়োজন। আর প্রকল্প ব্যয় ২৫ হাজার কোটি টাকার কম হলে এর জন্য শুধু পরিকল্পনামন্ত্রীর অনুমোদন হলেই চলে। তবে স্বাস্থ্যখাতের প্রকল্পটিতে ২০ কোটি থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন উপ-প্রকল্প রয়েছে। উপ-প্রকল্পগুলোর প্রস্তাবিত ব্যয়ের শতকরা ১০ ভাগ হ্রাস-বৃদ্ধি করে অনুমোদনের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্টিয়ারিং কমিটিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন এর বিরোধিতা করেছে। কারণ, বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কোনো বিনিয়োগ প্রকল্প অনুমোদন দেয়ার নিয়ম নেই। এ হিসাবে প্রতিটি উপ-প্রকল্পের জন্য আলাদাভাবে একনেক থেকে অনুমোদন নিতে হবে। কিন্তু দীর্ঘসূত্রতার কথা বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করায় পরিকল্পনা কমিশনের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
ওএসডি, অব্যাহতি : প্রকল্প অনুমোদন নেয়ার জন্য সরকার পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের ওপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করছে। চাপে নতিস্বীকার করে প্রকল্প অনুমোদন দেয়া না হলে কর্মকর্তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। আবার কখনও দেখানো হয় ওএসডি’র ভয়। সরকারের চাপে নিয়ম ভেঙে অনুন্নয়ন খাতের পরিকল্পনা অনুমোদন দিচ্ছে একনেক।
জানা যায়, পরিকল্পনা কমিশনের নিয়ম না মেনে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন খাতের তৃতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প ফেরত পাঠায় পরিকল্পনা কমিশন। দাতাদের পরামর্শে নিয়ম ভেঙে উন্নয়ন-অনুন্নয়ন মিলে ৫৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্প অনুমোদন দিতে চাপ দেয় সরকার। সরকারের চাপে প্রকল্পটি অনুমোদন দিতে পরিকল্পনা কমিশন বাধ্য হয়। এক্ষেত্রে নিয়ম লঙ্ঘনের বিষয়টি একনেক বৈঠকে তুলে ধরায় ওএসডি করা হয় পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সদস্যকে।
আবার বিতর্কিত ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পে পরিকল্পনা কমিশন নতিস্বীকার না করায় বরাদ্দ না বাড়িয়েই প্রকল্পটি সংশোধন করতে বাধ্য হয় সরকার। তবে এ দৃঢ়তা দেখানোর কারণে পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট সদস্যকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এ পদে নতুন একজন সদস্য বসিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে ১০টি প্রকল্প অনুমোদন নেয় সরকার।
অর্থসঙ্কটে এডিপি : এদিকে অর্থসঙ্কটের কারণে চলতি অর্থবছরের শুরুতেই এডিপির বাস্তবায়ন নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সহস্রাধিক উন্নয়ন পরিকল্পনা থাকলেও সে তুলনায় বরাদ্দ দিতে পারছে না অর্থ মন্ত্রণালয়। ফলে অর্থসঙ্কটে মুখ থুবড়ে পড়ছে এডিপি।
জানা যায়, গত অর্থবছরে শেষ হয়নি—এমন ৯৬২টি এবং নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত ৭৭টি প্রকল্পসহ চলতি অর্থবছরে ১ হাজার ৩৯টি প্রকল্প চালু রাখতে চলতি অর্থবছরের ৬৯ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। অথচ এনইসি চলতি অর্থবছরে মাত্র ৪৬ হাজার কোটি টাকার এডিপি নির্ধারণ করেছে। ফলে অর্থবছরের শুরুতেই এডিপি বাস্তবায়নে ২৪ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে। গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় এডিপি বাস্তবায়ন করতে হলে চলতি অর্থবছরের অতিরিক্ত ঘাটতি দাঁড়াবে ৪১ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা।
এ বিশাল ঘাটতি পূরণের কোনো উপায় খু্ঁজে পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা। বাধ্য না হয়ে এডিপিতে প্রকল্পের সংখ্যা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার এডিপির প্রকল্প সংখ্যা কমানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি চলতি অর্থবছরে সমাপ্তির জন্য রাখা ২২৫টি প্রকল্পে অর্থায়ন করার নির্দেশ দিলেও তা অমান্য করে নেয়া হচ্ছে নতুন প্রকল্প।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের প্রধান ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, সরকার ভালো-মন্দ বিবেচনা না করেই রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকল্প নিচ্ছে। তবে অর্থের অভাবে এসব প্রকল্প চালু রাখতে পারছে না। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে চলতি অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলে দাবি করেন তিনি। বৃহত্ প্রকল্পের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষের উন্নয়নের লক্ষ্যে উন্নয়নমুখী ছোট প্রকল্প নেয়ার পরামর্শ দেন ড. মাহবুব উল্লাহ।

No comments

Powered by Blogger.