জাতিসংঘে হাসিনা যা বললেন এবং যা বললেন না by মনজুর আহমদ

জাতিসংঘে বাত্সরিক সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরে গেছেন। বিশাল বহর নিয়ে তার নিউইয়র্কে আসা, নানা অনুষ্ঠানে তার অংশগ্রহণ, সাধারণ পরিষদে ভাষণদান ইত্যাদি সব খবরই বাংলাদেশের মানুষ সবিস্তারে জানতে পেরেছে। শেখ হাসিনা সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেন ২৪ সেপ্টেম্বর। এদিনের বক্তা তালিকায় ১৭ জনের মধ্যে তার স্থান ছিল ১৫। তৃতীয় বক্তা ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং।
লক্ষ্য করা গেছে, মনমোহন সিংয়ের বক্তৃতার সময় বাংলাদেশ গ্যালারিতে প্রধানমন্ত্রী বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো নয়ই, জাতিসংঘে নিযুক্ত স্থায়ী প্রতিনিধি কিংবা কোনো কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন না। তার বক্তব্য শোনাকে কেউ বোধহয় প্রয়োজন মনে করেননি। একইভাবে শেখ হাসিনার বক্তৃতার সময়ও ভারতীয় গ্যালারি ফাঁকা দেখা গেছে। শুধু একজন সাধারণ কর্মকর্তা সেখানে উপস্থিত থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন। শেখ হাসিনা বক্তৃতা করেছেন বাংলায়। বক্তৃতাটি ছিল ছাপার হরফে ৯ পৃষ্ঠা। কী বলেছেন তিনি বিশ্বসভায় দেয়া তার এই বক্তৃতায়? বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় তিনি তার উদ্ভাবিত একটি মডেল পেশ করেছেন। আমি জানি না তার এই মডেল আদৌ বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে কিনা, তারা একে স্বাগত জানিয়েছেন কিনা কিংবা এ নিয়ে তারা কোনো চিন্তা-ভাবনা করছেন কিনা। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, আর কোনো বক্তাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই শান্তি মডেল প্রসঙ্গে একটি কথাও বলেননি। কেউ তাদের বক্তৃতায় এ বিষয়ের কোনো উল্লেখও করেননি। সবচেয়ে বড় কথা, জাতিসংঘও তার এ মডেল বিবেচনায় নিয়েছে বা এ ব্যাপারে কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করেছে এমন কোনো আভাস পাওয়া যায়নি। বসু্তত শেখ হাসিনার এই বিশ্ব শান্তির মডেল সাধারণ পরিষদের চার দেয়ালের মধ্যেই মাথা ঠুকে মরেছে।
বিশ্ব সংস্থার বক্তৃতা স্তম্ভে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা বিশ্ববাসীকে শোনালেন তার নিজের কীর্তিগাথা, তার পিতার অবদান, তার প্রতিষ্ঠা। তার এই ‘আমিত্ব’ ভারাক্রান্ত ভাষণে বাংলাদেশের সব কর্মকাণ্ডে তিনিই প্রধান হয়ে উঠেছেন, দেশ নয়। তার আমিত্বের অহংবোধ এতই প্রবল যে, তার বর্ণিত কোনো সাফল্যের ক্ষেত্রে সমষ্টিগত কৃতিত্বের কথাও উল্লিখিত হয়নি। তার ভাষণে ‘আমরা’ শব্দটি ব্যবহারে যথেষ্ট কার্পণ্য লক্ষ্য করা যায়, যা কিছুই সাফল্য এককভাবে তার নিজের। সমষ্টিগতভাবে তাদের কিংবা বাংলাদেশের নয়। বিশ্ব সংস্থাকে শেখ হাসিনা বললেন, ‘আমি বিশ্বাস করি ন্যায়বিচার শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম নিয়ামক। ১৯৯৭ সালে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে পার্বত্য এলাকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষার জন্য আমি পার্বত্য শান্তি চুক্তির বিষয়ে মধ্যস্থতার পথ বেছে নিয়েছিলাম। এই চুক্তির ফলে ২০ হাজার মানুষের প্রাণ সংহারকারী দুই দশকের সংঘাতের অবসান ঘটে। এর পরই তিনি বললেন, ‘একই সময় আমি প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে ৩০ বছরমেয়াদি গঙ্গা পানি চুক্তি স্বাক্ষর করি।’ শেখ হাসিনা বললেন না, ‘বাংলাদেশ’ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে এই চুক্তি স্বাক্ষর করেছে কিংবা ‘আমরা’ স্বাক্ষর করেছি। এ সবই তিনি তার ব্যক্তিগত সাফল্য হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা ছাড়া শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এ জন্যই ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের জন্য একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছি।’ বক্তৃতায় তিনি আরও বললেন, ‘আমি সব ধরনের সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমি ব্যক্তিগতভাবে সন্ত্রাসের শিকার। আপনারা জানেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমার পিতা বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আমার মা ও তিন ভাইসহ পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমি অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে সেই নৃশংস ঘটনা স্মরণ করছি। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আমার দলের একটি শান্তি সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করা হয়। এতে ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন এবং আহত হন পাঁচ শতাধিক। ওই জঘন্য ঘটনায় অলৌকিকভাবে আমি প্রাণে রক্ষা পেলেও আমার শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়।’ প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি কোথায় দাঁড়িয়ে কাদের বিরুদ্ধে এবং কী উদ্দেশ্যে এসব কথা বললেন? স্থানটি তো বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নয়। এটা তো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ। ১৯৩টি দেশকে প্রতিনিধিত্ব করে এই সংস্থা। এখানে উত্থাপিত হয় আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক বা দ্বিপক্ষীয় সমস্যাবলী। বিশেষ করে যেসব বিষয় নিয়ে রয়েছে বিরোধ, সংঘাত। গৃহযুদ্ধ বা বিশ্ব সংস্থার হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে এমন কোনো ঘটনা ছাড়া কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়, নিজেদের মধ্যকার বিবাদ-বিসম্বাদের কথা বলার স্থান নিশ্চয় এটি নয়। বাংলাদেশের একান্ত নিজস্ব যেসব বিষয় তিনি তার বক্তৃতায় তুলে ধরেছেন এর কোনোটির ব্যাপারেই জাতিসংঘের করণীয় কিছু নেই এবং তিনিও কোনো বিষয়ে জাতিসংঘের দৃষ্টি কামনাই করেননি। তাহলে তিনি কেন দেশের এসব ঘরোয়া বিষয় বিশ্ব সংস্থায় উত্থাপন করলেন? অবশ্য এবারই প্রথম নয়, এর আগেও তিনি একইভাবে দেশের এসব একান্ত অভ্যন্তরীণ বিষয় বিশ্ববাসীর কাছে পেশ করেছেন। জাতীয় সংসদে দেয়া বিবৃতির মতো শেখ হাসিনা জাতিসংঘেও তার সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি দিয়েছেন। দারিদ্র্যবিমোচন, নারী কল্যাণ, ডিজিটাল বাংলাদেশ, চার হাজার পাঁচশ’টি তথ্য ও সেবা কেন্দ্র উদ্বোধন, আট হাজার পাঁচশ’টি পোস্ট অফিসকে ই-পোস্ট অফিসে রূপান্তর, কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন প্রভৃতির কথা তিনি শুনিয়ে গেলেন বিশ্ব সংস্থায়। তিনি শোনাতে ছাড়লেন না বিডিআর বিদ্রোহের কথা। বললেন, ‘আমার দায়িত্ব গ্রহণের শুরুতেই সীমান্তরক্ষী বাহিনীতে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। এতে ৭২ জন মানুষ নিহত হন। আমি আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান করি। এতে আরও প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব হয়।’ সাধারণ পরিষদে এবারের দেয়া বক্তৃতায় শেখ হাসিনা শান্তির মডেল উপস্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে ‘শান্তির পক্ষে একজন অগ্রণী ও নির্ভীক যোদ্ধা’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘গত অর্ধশতাব্দী ধরে আমি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছি। পুরো সময়ে আমি ছিলাম শান্তির পক্ষে একজন অগ্রণী ও নির্ভীক যোদ্ধা।’ তার উপস্থাপিত শান্তির মডেল বিশ্ব সভায় সমাদৃত হোক বা না হোক তার নিজেকে শান্তির অগ্রণী ও নির্ভীক যোদ্ধা ঘোষণা দেয়াকে নেহাত উদ্দেশ্যহীন বলে মনে করছেন না জাতিসংঘ সম্পর্কে ওয়াকেবহাল বাংলাদেশী পর্যবেক্ষক মহল। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং শেখ হাসিনার আত্মপ্রচার প্রাধান্য পাওয়া তার এই বক্তৃতা জাতিসংঘের ভাষণ হিসেবে কোনো গুরুত্ব বহন করে না বলে তারা মন্তব্য করেছেন। শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কিছু বললেন না। তার এই কিছু না বলা পর্যবেক্ষক মহলকে বিস্মিত করেছে। তিনি কিছুই বললেন না অথচ এবার ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের বিষয়টি ছিল জাতিসংঘে সবচেয়ে উত্তপ্ত ইস্যু। ফিলিস্তিনি নেতা মাহমুদ আব্বাস এ দাবি নিয়ে জাতিসংঘে এসেছিলেন এবং যুক্তরাষ্ট্র এর বিরুদ্ধে ভেটোর খড়গ শানিয়ে রেখেছিল। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ অব্যাহতভাবে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে চলেছে। দেশ শাসনের সূচনাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফিলিস্তিনি স্বার্থের পক্ষে বাংলাদেশের সর্বাত্মক সমর্থনের কথা ঘোষণা করেছিলেন। হাসিনার এই ভূমিকায় পর্যবেক্ষক মহলের বিস্ময়, বাংলাদেশ কি সেই অবস্থান থেকে সরে আসছে? তিনি কি যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কারও মুখ চেয়ে নীতিগত ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন আনছেন? পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, জাতিসংঘের যে প্রস্তাবের ভিত্তিতে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, আটচল্লিশের সেই প্রস্তাবে তো ফিলিস্তিনিদের জন্যও পৃথক রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছে। কাজেই এ প্রশ্নে কারও মুখের দিকে চেয়ে বাংলাদেশের দোদুল্যমানতার কোনো কারণ থাকতে পারে না। শেখ হাসিনার বক্তৃতায় লিবিয়া প্রসঙ্গ উপেক্ষিত থাকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন পর্যবেক্ষক মহল। যে ট্রানজিশনাল বিপ্লবী পরিষদ এখন লিবিয়ার শাসন ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ এবং খোদ জাতিসংঘ যাদের স্বীকৃতি দিয়েছে, তাদের ব্যাপারে বাংলাদেশের নীরবতা কল্যাণকর নাও হতে পারে বলে তারা মনে করেন। তারা বলেন, লিবিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় জড়িত রয়েছে। বিশেষ করে জনসম্পদ রফতানির বিষয়। এখনও বহু বাংলাদেশী লিবিয়াতে অবস্থান করছে। এই সার্বিক দিক বিবেচনায় লিবিয়ার নতুন সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক গড়ে তোলা জরুরি বলে তারা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। উল্লেখ্য, লিবিয়ার নতুন বিপ্লবী সরকারের প্রধান সাধারণ পরিষদের এই চলতি অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন এবং প্রেসিডেন্ট ওবামার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় ফিলিস্তিনি প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহনসিং তার সুলিখিত প্রজ্ঞাপূর্ণ ভাষণে ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে ভারতের ভূমিকা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি সার্বভৌম, স্বাধীন, স্থিতিশীল, অখণ্ড ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ফিলিস্তিনি জনগণের লড়াইয়ের প্রতি সমর্থনে ভারত অটল। মনমোহন সিংয়ের বক্তৃতায় আফগানিস্তান প্রসঙ্গ আছে, সে দেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট বোরহানুদ্দিন রব্বানির হত্যাকাণ্ডে দুঃখ ও উদ্বেগ প্রকাশ আছে। সোমালিয়া, কেনিয়া, জিবুতির খরা সমস্যার কথা আছে এবং এর মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক প্রয়াস গ্রহণের আহ্বান আছে। পশ্চিম এশিয়া, উপসাগরীয় অঞ্চল এবং উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক গণঅভ্যুত্থান ও পটপরিবর্তন, বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা প্রভৃতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ তার ভাষণে রয়েছে এবং সে সঙ্গে রয়েছে এসব বিষয়ে জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে বক্তব্য। তিনি আহ্বান জানিয়েছে, জাতিসংঘকে আরও জোরদার ও কার্যকর করার। প্রস্তাব দিয়েছেন নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদকে ঢেলে সাজানোর। প্রশ্ন হচ্ছে, এত সব আন্তর্জাতিক বিষয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে নেই কেন?
নিউইয়র্ক, ১ অক্টোবর ’১১
dhrubo718@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.