সকালেই ভেঙে যায় স্বপ্ন by সঞ্জয় সাহা পিয়াল

ল্পটি গল্পের মতোই ধরা থাকল। টাইম মেশিনে চেপে আর ১৯৩০ সালের 'টাইমলেস টেস্টে'র ধারে-কাছে যাওয়া হলো না। টেস্টে সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের ইতিহাসও ঘাঁটতে হলো না। 'রেকর্ড' শব্দটি নিয়েও নাড়ানাড়ি হলো না। ৫০৮ রান তাড়া করা দূরে থাক, বিশুর দাবড়ানিতে নিজেরাই দৌড়ের ওপর থাকলেন। কেউ বিলাসিতায় উইকেট বির্সজন দিলেন আর কেউ না পেরে আত্মসমর্পণ করলেন। গতকাল ঢাকা টেস্টে মুশফিকরা ২৭৮ রানে অল আউট হয়ে বরং বাস্তবে ফিরিয়ে আনলেন সমর্থকদের।


যারা আগের দিন নাঈম ইসলামের ঘোরের মধ্যে বলা 'আমরা জয়ের জন্যই নামব। খেলতে পারলে জয় সম্ভব।'_ কথাটি বিশ্বাস করে সকাল সকাল টিভি খুলেছিলেন, তারা তামিমের ৮৩ রানে উন্মাদ আউট হওয়া দেখার পরই অন্য কাজের প্রতি মনোযোগ দেন। তারপরও সাকিবের ৫৫ রান দেখে যারা মনে করছিলেন, দেখা যাক কী হয়? লাঞ্চের একটু আগে তারাও সাকিবের বিলাসিতা দেখে রাগে গিজগিজ করেছেন।
২২৯ রানের বিশাল ব্যবধানের হারটা বাংলাদেশিদের জন্য আকাশ থেকে পড়ার মতো ঘটনা না হলেও যেভাবে সাকিব-তামিমের মতো দলের সিনিয়র ক্রিকেটাররা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন তাতে কোনো মা যদি তার ছেলেকে আর মিরপুরমুখো হতে বারণ করেন, তাতে দোষের কিছু থাকবে না। কারণ এদিন ক্যারিবীয় বোলাররা নন, সাকিবরা নিজেরাই নিজেদের আউট করেছেন। অন্য কেউ নন, খোদ ওয়েস্ট ইন্ডিজের অভিজ্ঞ ক্রিকেটার শিবনারায়ণ চন্দরপলও এ সত্যটি বলে গেছেন। 'ব্যাটসম্যানরা যদি আরেকটু দায়িত্ব নিয়ে খেলতেন তাহলে অন্তত আরও কিছু সেশন খেলতে পারতেন। উইকেটে এমন কিছু ছিল না যে ব্যাট করা যাচ্ছিল না।' চন্দরপলই বলেছেন, 'তোমরা নিজেরাই নিজেদের আউট করেছ, আমরা করিনি।' মুশফিকের আক্ষেপ, মানসিকতায় পরিবর্তন না আনলে স্বপ্নগুলো স্বপ্নই থেকে যাবে।
পুরোটা দিন হাতে রেখে ৭ উইকেটের মজুদ নিয়ে ৩৪৪ রানের চূড়ায় ওঠার স্বপ্ন চোখে খেলা দেখতে এসেছিল স্কুলপড়ূয়ার দল; কিন্তু ম্যাচ শুরুর ১৭ বল পরই বিশুকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে কাঁচা স্বপ্নটা চটকে দেন তামিম। সবেই দিন শুরু হয়েছে, কোথায় একটু রয়ে-সয়ে থাকবেন তা না, তামিম ডাউন দ্য উইকেটে এসে চালাতে গিয়েছিলেন বিশুকে। স্লিপে স্যামির হাতে ধরা পড়ে তামিম শুধু নিজের সেঞ্চুরির সম্ভাবনাই মাটিতে মিশিয়ে দেননি, সে সঙ্গে আগের দিন বুক ফুলিয়ে বলা নাঈম ইসলামকেও মিথ্যাবাদী বানিয়ে দিয়েছিলেন। এরপরও সাবেক অধিনায়ক সাকিবকে নিয়ে বর্তমান অধিনায়ক মুশফিক 'কিছুই হয়নি' ধরে নিয়ে ব্যাট করছিলেন। ভালোই চলছিল সবকিছু। পঞ্চম উইকেট জুটিতে ৮৮ রানও এসেছিল প্রতি ওভারে ৪.৭৫ গড় নিয়ে। সাকিব এরই মধ্যে বেশকিছু দারুণ শটও খেলেছেন বিশুকে। নিজের হাফ সেঞ্চুরিও পূরণ করে ব্যাট দেখিয়েছেন ড্রেসিংরুমে। তখনও পর্যন্ত মনে হচ্ছিল, প্রথম সেশনে আর কোনো অঘটন ঘটবে না; কিন্তু মনে করাটা মনেই থেকে যায়। লাঞ্চের কয়েক মিনিট আগে স্যামিকে অযথা চালাতে যান এক অক্রিকেটীয় শটে। ব্যাটকে কোমরের কাছে টেনে স্যামির অফ সাইডের বল কব্জির মোচড়ে লেগের দিকে ঘোরাতে যান সাকিব; কিন্তু মোচড়ে কাজ হয়নি, গালি থেকে দৌড়ে এসে চন্দরপল ক্যাচটি লুফে নেন। সাকিব বুঝে যান, ঢাকা টেস্টের অর্ধেক মৃত্যু সেখানেই হয়ে যায়। ক্রিজে দাঁড়িয়েই খুব আফসোস করতে দেখা যায় সাকিবকে; কিন্তু তাতে মন গলেনি কোচ স্টুয়ার্ট ল'র। ড্রেসিংরুমে ফিরলেই সাকিবকে কথা শুনতে হয়। সাকিব চলে যাওয়ার পর মুশফিকের ভিতও নড়ে যায়। সুযোগ বুঝে বেকায়দায় পড়া অধিনায়ক মুশফিককে বোল্ড করেন বিশু। আগের দিন বিকেল থেকে লড়াই করে যাওয়া অধিনায়ক মুশফিকের ১৪২ মিনিটের ইনিংস শেষ হয় ১০৯ বলে ৬৯ রানে।
২৬০ রানে ৬ উইকেট। স্কোর বোর্ডটা স্থির রেখে লাঞ্চে যায় বাংলাদেশ; কিন্তু ফিরে এসে পেট আরও খালি হয়ে যায় মাত্র ১৮ রানে ৪ উইকেট পড়তে দেখে। লেগ স্পিনার বিশু এরই মধ্যে তার বিষ ছড়াতে থাকেন ক্রিজে। শেষ চার উইকেটের তিনটিরই দখল নেন তিনি। বাকিটা কেমার রোচ নিয়ে এ সিরিজে কিছু একটা করার স্মৃতি নিয়ে বাড়ি ফেরেন।
অতীত বলছে, ঘরের মাঠে খেলা ৩৫ টেস্টের মধ্যে এটা হলো বাংলাদেশের ২৯তম হারা টেস্ট। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলা ৮ টেস্টের মধ্যে চতুর্থবার হারা টেস্ট বাংলাদেশের। সিরিজের প্রথম টেস্ট চট্টগ্রামে ড্র করার পর ঢাকা জয় করে ১-০ সিরিজের ট্রফিটি বাড়ি নিয়ে গেলেন স্যামিরা। সে সঙ্গে সিরিজের সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী কির্ক অ্যাডওয়ার্ডের চেকটিও নিয়ে যায় তারা। আর ঢাকা থেকেই অন্য এক বিশুকে পেয়ে যায় তারা। এ টেস্টে ১৫২ রান দিয়ে ৮ উইকেট দখলে নিয়েছেন বিশু, ক্যারিবীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে ল্যান্স গিবসের পর বিশুই হলেন প্রথম স্পিনার যিনি কি-না নিরপেক্ষ ভেন্যুতে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি ক্যারিবীয় স্পিনার। এর আগে ১৯৭৫ সালে ভারতের বিপক্ষে গিবস ১৪৩ রানে ৯ উইকেট শিকার করেছিলেন।
এক মাসের বাংলাদেশ সফর শেষে গতকালই বাড়ি ফিরে যান স্যামিরা। যাওয়ার বেলায় বাংলাদেশি সমর্থক আর বাংলাদেশের আতিথেয়তার প্রশংসা করে যান। উড়িয়ে দিয়ে যান প্রতিশোধের কথাটিও। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ হোয়াইটওয়াশ করেছিল তাদের। এ সিরিজে তারা সেটি না পারলেও ওয়ানডে এবং টেস্ট সিরিজ জিতেছে। 'প্রতিশোধ নয়, সিরিজ জয়টা আমাদের একটি অর্জন।' ক্যারিবীয়দের এ ভদ্রতার নমুনা রেখে গেছেন চন্দরপলও। মুশফিকদের সবাইকে নিয়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে বলে যান, 'আরও ধৈর্য নিয়ে টেস্ট খেল। অনুশীলনে ফাঁকি দিও না। দেখবে একদিন তোমারও পারবে...।'

No comments

Powered by Blogger.