ঘরমুখো মানুষের দুর্ভোগ by সোহেল মামুন

শুক্র-শনি সাপ্তাহিক ছুটি যুক্ত হয়ে এবার ঈদে সরকারি ছুটি পাঁচ দিন। বৃহস্পতিবার দিনটি ছুটি নিয়ে গতকাল বুধবার যারা একটু আগেভাগে ঢাকা ছাড়তে চেয়েছেন, তারা পড়েছেন মহাবিপাকে। প্রিয়জনের সানি্নধ্যের আশায় ঢাকার বাসা থেকে বেরিয়ে আসা ঘরমুখো মানুষকে গতকাল যাত্রার আগেই ট্রেন ও বাস টার্মিনালে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়তে হলো। যারা গন্তব্যের উদ্দেশে সকালে স্টেশন বা টার্মিনাল ছেড়েছিলেন, তারাও পথে পথে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন।
গতকাল ভোরেই ভিড় শুরু হয় কমলাপুর রেলস্টেশন, সায়েদাবাদ ও গাবতলী বাস টার্মিনাল এবং সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে। নরসিংদীতে বগিতে আগুন দেওয়ায় ট্রেনের সিডিউলে বিপর্যয় ঘটে।


দুপুরে কয়েক ঘণ্টা বন্ধ থাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট ট্রেন চলাচল। দীর্ঘ প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে থাকেন যাত্রীরা। একই জেলায় অবরোধ থাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বিভিন্ন রুটের দূরপাল্লার বাস চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। মঙ্গলবার রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লায় ট্রাক উল্টে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে যানজটের সূত্রপাত হয়। বুধবার ভোরে আরও দুটি দুর্ঘটনায় এ মহাসড়ক প্রায় অচল হয়ে পড়ে।
রেলওয়ের ঢাকা স্টেশন ম্যানেজার সিধাংশু চক্রবর্তী সমকালকে বলেন, নরসিংদীর ঘটনায় সারাদেশের ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, একটি মহাসড়ক বন্ধ। আরেকটিতে দীর্ঘ যানজট। দ্রুত রাস্তার যানজট দূর না হলে মানুষের দুর্ভোগের শেষ থাকবে না। পরিবহন মালিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
ট্রেন :ট্রেনের আগাম বিক্রীত টিকিটের প্রথম দিনের যাত্রা ছিল গতকাল।
সরেজমিন কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে জানা গেছে, নরসিংদীতে ট্রেনের বগিতে আগুন দেওয়ার আগেই সিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে। সকাল থেকেই কোনো ট্রেন সময়মতো স্টেশন ছেড়ে যায়নি।
স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে দুই শিশুকন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন রংপুরের যাত্রী শহিদুল ইসলাম। তিনি জানালেন, সকাল ৭টায় কমলাপুর রেলস্টেশন ছাড়ার কথা ছিল রংপুর এক্সপ্রেসের। চার ঘণ্টা দেরি করে রংপুর থেকে ট্রেনটি ঢাকা এসে পেঁৗছে সকাল ১১টায়। স্টেশনেই যাত্রীদের পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হলো। অপেক্ষা এখনও শেষ হয়নি। দেখার বিষয় ট্রেনটি কখন ছাড়ে। ওই ট্রেনের একজন কর্মচারী জানালেন, রংপুরে দুটি অতিরিক্ত বগি যুক্ত করতে গিয়ে সেখান থেকে দেরিতে ছাড়ে ট্রেনটি।
রাজশাহীর উদ্দেশে ধূমকেতু ট্রেন ছাড়ার কথা ছিল সকাল ৬টায়। দুই ঘণ্টা দেরি করে তা ছেড়ে যায় ৮টায়। সুন্দরবন ট্রেনটি খুলনার উদ্দেশে ৬টা ২০ মিনিটে কমলাপুর ছেড়ে যাওয়ার কথা। ছাড়ে ৯টায়। ঢাকা-কলকাতা মৈত্রী এক্সপ্রেস সকাল ৭টার পরিবর্তে ৮টায় ছেড়ে যায়। দিনাজপুরের উদ্দেশে একতা এক্সপ্রেস ছেড়ে যাওয়ার সময় ছিল ৯টা ৫০ মিনিটে। দুপুর ১২টায়ও ট্রেনটি কমলাপুরে এসে পেঁৗছেনি। জামালপুরের যমুনা এক্সপ্রেস সকাল সাড়ে ৯টায় স্টেশন ছাড়ার কথা থাকলেও দুপুর ১২টায় ট্রেনটি স্টেশন ছেড়েছে। মহানগর গোধূলী বিকেল ৩টায় ছাড়ার কথা থাকলেও সন্ধ্যা পর্যন্ত ট্রেনটি স্টেশন ছাড়েনি। একই ঘটনা ঘটেছে রাজশাহীগামী সিল্কসিটি ট্রেনের ক্ষেত্রে।
ট্রেনের টিকিটের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর এবার ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষায় যাত্রীদের কেটে যাচ্ছে দিন-রাত। পথে পথে ভোগান্তির কথা ভেবে দুশ্চিন্তা আরও বাড়ছে তাদের।
সকাল থেকে সিডিউল বিপর্যয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার সিধাংশু চক্রবর্তী রেলওয়ের লোকবল সংকটকে দায়ী করেন। ঈদে যাত্রীর চাপ বেড়ে যায়। ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো হয়। ফলে সময়সূচিতে এ ধরনের বিপর্যয় ঘটে।
বাস : সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল, কল্যাণপুর ঘুরে দেখা গেছে, নামি বেসরকারি বাস সার্ভিসের কাউন্টারেও যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন বাসের জন্য। কাউন্টারের ওয়েটিং রুমে স্থান সংকুলান না হওয়ায় রাস্তার পাশে লাগেজের ওপর বসে ছিল বাচ্চারা। পত্রিকা বিছিয়ে বড়রাও বাসের অপেক্ষায় রাস্তায় অপেক্ষমাণ।
ইউনিক পরিবহনের সায়েদাবাদ কাউন্টারের ব্যবস্থাপক আনোয়ার হোসেন জানালেন, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নরসিংদীতে অবরোধ থাকায় ওই রুটে বাস চলাচল বন্ধ। সিলেট-সুনামগঞ্জের আগাম টিকিটের যাত্রীদের ঢাকা থেকে কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রুট দিয়ে গন্তব্যে পেঁৗছানোর উদ্যোগ নিয়েছে কিছু বাস সার্ভিস।
হানিফ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব হোসেন সমকালকে বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লায় একাধিক সড়ক দুর্ঘটনায় দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এতে ফিরতি বাস ঢাকায় সময়মতো পেঁৗছতে পারছে না। ফলে নির্ধারিত সময়ের দুই-আড়াই ঘণ্টা দেরিতে সায়েদাবাদ টার্মিনাল ছাড়ছে দূরপাল্লার বাসগুলো।
বাবা-মা, মামা-মামিসহ শ্যামলী পরিবহনের সামনে অপেক্ষা করছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তানিয়া। তিনি জানালেন, চট্টগ্রাম যাবেন তারা। দুই ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছেন, বাস আসছে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্যামলী পরিবহনের সায়েদাবাদ এরিয়া ম্যানেজার সাগর জানান, যানজটের কারণে বাস আসতে পারছে না।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন বাস সার্ভিস কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রুটে বাস চালানোর সিদ্ধান্ত নিলেও ওই সড়ক খানাখন্দে ভরা বলে জানিয়েছেন যাত্রীরা। এ বিষয়ে জানতে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরে যোগাযোগ করলে এক কর্মকর্তা জানান, ওই রুটে ২২ কিলোমিটার জায়গায় খানাখন্দ রয়েছে। বড় সমস্যা হলো ওই পথে প্রায় ১০টি সেতু ঝুঁকিপূর্ণ। ভারী যান চলাচল করলে সেতুগুলোর অবস্থা আরও খারাপ হবে।
জানা গেছে, ঢাকা-ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল এবং ঢাকা-খুলনা ও সাতক্ষীরা সড়কে বড় গর্ত রয়েছে। এসব সড়কে খানাখন্দের কারণে ধীরগতিতে বাস চলছে। এতে গাড়ির চাপ বেড়ে গিয়েও যানজট বাড়ছে। নির্ধারিত সময়ের দ্বিগুণ সময় লাগছে গন্তব্যে পেঁৗছতে।
লঞ্চ :ট্রেন ও বাসের মতো দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়নি লঞ্চ যাত্রীদের। গত কয়েক দিনের তুলনায় গতকাল ভিড় ছিল অনেক বেশি। অনেক যাত্রী অভিযোগ করেছেন, লঞ্চের কিছু অসাধু কর্মচারী স্লিপ বা মোবাইল নাম্বার আদান-প্রদান করে বেশি ভাড়ায় অতিরিক্ত যাত্রী তুলছেন। এতে নিরাপদে বাড়ি পেঁৗছানো নিয়ে চিন্তিত এক-দেড় মাস আগে বুকিং দেওয়া যাত্রীরা।

No comments

Powered by Blogger.