দুর্নীতি-লুটপাটের মহোৎসবঃ ক্ষমতা আঁকড়ে থেকে পার পাওয়া যাবে না

দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা আওয়ামী মহাজোটের নির্বাচনী ইশতেহারে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতায় বসেই অন্য অনেক কিছুর মতো এসব কথাও যে তারা ভুলে গেছে, সেটা এখন মানুষ খালি চোখেই দেখছে। দেশজুড়ে এমন অবাধ দুর্নীতি, লুটপাটের ঘটনা আগে কমই দেখা গেছে। গত বুধবারের দৈনিক আমার দেশ ‘উন্নয়ন কাজের নামে লুটপাট-এর যে বিবরণ প্রকাশ করেছে, তা পড়ে হতভম্ব হলে কাউকে দোষ দেয়া যাবে না।

সরকারি কাজে দুর্নীতি, বরাদ্দের টাকা লুটপাট কমবেশি সবসময়ই ছিল। তবে তার মধ্যেই উন্নয়নের গতি মানুষের চোখ এড়িয়ে যেত না। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা পরিষ্কার হয়ে গেছে গত ঈদের সময় দেশের সড়ক-মহাসড়কের বেহাল অবস্থা থেকে। এমনটা তো হঠাত্ করে হয়নি। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সরকারি দলের নেতা-পাতিনেতা, কর্মী-ক্যাডাররা সবাই হামলে পড়েছে উন্নয়ন কাজের ওপর। ঘরে-বাইরে ম্যানেজ করে সবকিছু তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের বাইরে থেকে কারও পক্ষেই সরকারের উন্নয়ন কাজ পাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠেছে। তাদের সঙ্গে রফা করে চলার ফলে প্রকল্প বরাদ্দের সিংহভাগই চলে যায় পকেটে। ঘাটে ঘাটে কমিশন ও ঠিকাদারের লাভ বাদ দিয়ে যা থাকে, তা দিয়ে কাজ হয় মূলত লোক দেখানো। মান বলতে কিছুই থাকে না। এভাবেই চলছে সড়ক-মহাসড়ক-ব্রিজ নির্মাণ ও সংস্কার, নদীখনন, বাঁধ নির্মাণসহ বিভিন্ন মেরামত কাজ। এসব ক্ষেত্রে এলজিইডি, সড়ক বিভাগ, ওয়াসার মতো অবকাঠামো ও সেবা খাতের কাজ সম্পর্কে যে তথ্য প্রকাশ পেয়েছে, তা রীতিমত বিস্ময়কর। মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন টেবিলে কার হাতে কত কমিশন যায় সরকারি বরাদ্দের টাকা, সেটা থেকেই বুঝতে অসুবিধা হয় না দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন না হলেও কিছু ব্যক্তির উন্নতি কেন সবার নজর কাড়ে! অর্থনীতি স্থবির হলেও তাদের কেনাকাটার শেষ নেই। চোখ ঝলসানো বিলাসী জীবনের পেছনে রয়েছে অসত্ আয়ের উত্সব।
ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে দেশের উন্নয়নই শুধু ব্যাহত হচ্ছে না, বিদ্যমান অবকাঠামো ও সেবা খাতও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ফলে সড়ক যোগাযোগ, বিদ্যুত্, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানি সরবরাহ—সর্বত্রই বিপর্যয় নেমে এসছে। ঘুষ ছাড়া চাকরি হয় না বলে সবখানেই যোগ্যতা ছাড়াই নিয়োগ হচ্ছে। শিক্ষকদের হাতে ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনেও অন্য কোনো কারণ নেই। রাজনীতি থেকে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে অজপাড়াগাঁ পর্যন্ত। গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (টেস্ট রিলিফ বা টিআর) এবং কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) প্রকল্পের নিয়ন্ত্রক হয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতে মেতে উঠেছে। গ্রামীণ দুস্থদের জন্য ভাতা বা মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিয়ে দুর্নীতিও থেমে নেই। দুর্নীতি-লুটপাটের এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বেশিরভাগই মন্ত্রী-এমপির আত্মীয় বা সরকারি দলের লোকজন হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কিছু করা কঠিন হয়ে উঠেছে। সর্বত্রই তাদের দাপটের সঙ্গে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী এই দুর্নীতিবাজরাই সর্বত্র সমাজের ঘাড়ে চেপে বসেছে। তাদের এড়িয়ে কোনো কাজ করা যে দুঃসাধ্য, সেটা ভুক্তভোগীমাত্রই স্বীকার করবেন। তারাই যে সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে, সেটা পরিষ্কার বোঝা যায় দুর্নীতি-লুটপাটের অভিযোগ ওঠার পরও এ পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে কর্তৃপক্ষের অক্ষমতা থেকে। এসব খবর এখন বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। এসব কারণে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থার কাছে সরকারের অভিযুক্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ অবস্থায় নিজেদের পিঠ বাঁচাতেই কি ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে উঠেপড়ে লেগেছেন ক্ষমতাসীনরা, সে প্রশ্নটাই দিন দিন বড় হয়ে উঠছে।

No comments

Powered by Blogger.