নরসিংদীবাসীর ক্ষোভের আগুন এগারো সিন্দুরে

মেয়রকে হত্যার ঘটনায় নরসিংদীর মানুষের ক্ষোভ রাত অতিক্রান্ত হওয়ার পর গতকাল ক্রোধের উন্মত্ততায় রূপ নেয়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আন্তনগর এগারো সিন্দুর এঙ্প্রেস ট্রেনের সাতটি বগি এই ক্রোধের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ক্ষুব্ধ জনতা ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে কয়েকটি গাড়িও ভাঙচুর করে। গত মঙ্গলবার রাতে মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে মুখোশপরা দুষ্কৃতকারীরা। এ খবরে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে গোটা শহর।


রাতেই বিক্ষোভকারীরা ভাঙচুর করে সার্কিট হাউসসহ বেশ কিছু যানবাহন ও দোকানপাট। তারা জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে তাঁর এক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির বাড়িতে হামলা চালায়।জ্বালাও-পোড়াওয়ের মধ্যেই ছাত্রলীগের ডাকা ৭২ ঘণ্টার হরতাল দুপুর দেড়টায় দিকে সাময়িকভাবে স্থগিতের ঘোষণা দেওয়া হয়। গতকাল সকাল থেকে একের পর এক খণ্ড মিছিল আসতে থাকে লোকমান হোসেনের বাড়ির সামনে। সেখান থেকে হাজার হাজার মানুষের বিশাল মিছিল শহরের বাসাইল এলাকায় গিয়ে রেললাইনের ওপর অবস্থান নেয়। ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জগামী এগারো সিন্দুর ট্রেনটি ঘোড়াশাল পার হয়ে সকাল সাড়ে ১০টায় নরসিংদী বাসাইল ওভারব্রিজের সামনে আসতে থাকলে বিক্ষোভকারীদের অনেকে রেললাইনের ওপর শুয়ে পড়ে। ট্রেনের চালক এ দৃশ্য দেখে ট্রেনটি দ্রুত থামান। সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজিত জনতা ট্রেনের বগিতে আগুন দেওয়া শুরু করে। যাত্রীরা ভয়ে ট্রেন থেকে দ্রুত নেমে পড়ে। বিক্ষোভকারীদের দেওয়া আগুনে নিমিষেই পুড়ে শেষ হয়ে যায় ট্রেনের সাতটি বগি। অক্ষত থাকে শুধু এর ইঞ্জিনটি।
খবর পেয়ে নরসিংদী, ভৈরব ও ঘোড়াশাল থেকে একাধিক অগি্ননির্বাপক দল এসে আগুন নেভানোর চেষ্টা করলেও ততক্ষণে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় বগিগুলো। ইঞ্জিনটিই কেবল রক্ষা করা সম্ভব হয়। অগি্ননির্বাপক দলকে সহযোগিতা করেন পুলিশ ও র‌্যাবের সদস্যরা। নরসিংদীর স্টেশন মাস্টার মরণ চন্দ্র দাস বলেন, 'মেয়রকে হত্যার ঘটনায় মঙ্গলবার রাতেও বিক্ষুব্ধ জনতা নরসিংদী স্টেশনে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করে। স্টেশনের কোনো মেশিনই এখন সচল নেই। এগারো সিন্দুরের ইঞ্জিন ছাড়া সবকিছুই পুড়ে গেছে, এতে সরকারের প্রায় পাঁচ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে।' দুপুরের দিকে ঢাকা থেকে একটি উদ্ধারকারী ট্রেন এসে এগারো সিন্দুর পুড়ে যাওয়া বগি ও ইঞ্জিন ঢাকায় নিয়ে যায়।
বিক্ষুব্ধ জনতা সংঘবদ্ধ হয়ে বুধবার সকাল থেকে শহরের রাস্তায় রাস্তায় টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে এবং বৈদ্যুতিক খঁুঁটি, গাছের গুঁড়ি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে জড়ো করে ব্যারিকেড দেয়। এতে মহাসড়কে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এতে একদিকে শিবপুর থেকে মহাসড়কের বারৈচা পর্যন্ত, অপরদিকে মহাসড়কের সাহেপ্রতাব থেকে পাঁচদোনা পর্যন্ত গাড়ির দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়। ওই অবস্থায় চরম ভোগান্তিতে পড়ে ঈদে ঘরমুখি মানুষ। অবস্থা বেগতিক দেখে দূর-দূরান্তের যাত্রীদের পায়ে হেঁটেই সামনে এগোতে দেখা যায়। বিকেলের দিকে মহাসড়কে যানচলাচল স্বাভাবিক হয়।
গতকাল মিছিলের স্লোগান ছাড়া শহরে অন্য কোনো সাড়াশব্দ ছিল না। দোকানপাট-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল বন্ধ। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে শহরের বিভিন্ন সড়কে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। দুপুর দেড়টায় ছাত্রলীগের ডাকা ৭২ ঘণ্টার হরতাল সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'লোকমান ভাইয়ের জানাজার কারণেই হরতালের কর্মসূিচ সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে।'
ট্রেন পোড়ানোর স্থলে কারখানার শ্রমিক রাজন, শাহিন, রুমন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের নেতাকে হত্যা করে যেন নরসিংদীকেই হত্যা করেছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই হত্যার বিচার চাই।' তাঁরা বলেন, জনপ্রিয়তায় ইর্ষান্বিত হয়ে একটি পক্ষ পরিকল্পিতভাবে লোকমানকে হত্যা করেছে। জ্বলন্ত বগির পাশে স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এগারো সিন্দুর যাত্রী আবদুল বাতেন বলেন, 'ঢাকা থেকে ঈদের ছুটিতে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের বাড়িতে যাচ্ছিলাম। বাসাইল এলাকায় আসার আগেই জনতা ট্রেনটি থামিয়ে দেয়। ভয়ে ট্রেন থেকে সন্তানদের নিয়ে নেমে গেছি।'
আগের রাতে ভাঙচুর-আগুন
নরসিংদীর জেলা প্রশাসক রোডে সার্কিট হাউস। রাতে লোকমান হত্যার খবর পেয়ে শত শত লোক সার্কিট হাউসে হামলা চালায়। বিক্ষুব্ধরা সার্কিট হাউসে ঢুকে বিভিন্ন কক্ষের আসবাবপত্র তছনছ করে আগুন ধরিয়ে দেয়। লোকজন জানায়, প্রতি সপ্তাহে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু এই সার্কিট হাউসে এসে অবস্থান করতেন। তাই এখানে হামলা করেছে তারা। যে কক্ষে তিনি রাত্রিযাপন করতেন, সেই কক্ষটিও ভাঙচুর করা হয়। সার্কিট হাউস থেকে বেরিয়ে জনতা রাজুর খুবই ঘনিষ্ট বলে পরিচিত, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হাজি সাত্তার হোসেনের বাড়িতে ভাঙচুর চালায়। বাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। হামলার আগেই হাজি সাত্তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান।
নরসিংদীর পুলিশ সুপার আক্কাছ উদ্দিন ভুঁইয়া বলেন, পৌর মেয়র হত্যার ঘটনার পর এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা চলছে। পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি এম এইচ নুরুজ্জামান, র‌্যাব ১১-এর অতিরিক্ত ডিআইজি লে. কর্নেল মোস্তফা কামাল রাতেই নরসিংদীতে আসেন। তিনি বলে 'আশপাশের জেলা থেকে বিপুল সংখ্যাক পুলিশ, র‌্যাব সদস্যকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নরসিংদী শহরে মোতায়েন করা হয়েছে।' হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের জন্য কয়েকটি টিম মাঠে নেমেছে।
এদিকে লোকমান হোসেন নিহত হওয়ার পর মঙ্গলবার গভীর রাতে নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি ও দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল কবীর খোকনকে ঢাকা থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাঁকে বুধবার সকালে পুলিশ নরসিংদী নিয়ে আসে।
গত মঙ্গলবার রাত ৮টায় দিকে শহরের সদর রোডে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে ঢুকে কয়েকজন মুখোশধারী মেয়র লোকমান হোসেনকে গুলি করে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। রাত ১১টার দিকে জানানো হয় তিনি বেঁচে নেই।

No comments

Powered by Blogger.