খাদ্য-সহায়তা কমার নেপথ্যে দুর্নীতি-সাহায্যের চাল-গম কোথায় যায় জানে না সরকার by আশরাফুল হক রাজীব

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিসহ (ডাবি্লউএফপি) বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর খাদ্য-সহায়তা কোথায় কিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা জানে না খাদ্য মন্ত্রণালয়। অথচ খাদ্য-নিরাপত্তার কথা বলেই এসব খাদ্যশস্য বাংলাদেশে আনা হয়। খাদ্যশস্য নিয়ে আসা থেকে শুরু করে বিতরণের বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারের একাধিক দপ্তর জড়িত থাকলেও তাদের কাজে সমন্বয় নেই। ডাবি্লউএফপি ও অন্য উন্নয়ন সংস্থাগুলো চুক্তি করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সঙ্গে। তাদের নিয়ে আসা খাদ্যশস্যের তত্ত্বাবধান করে খাদ্য বিভাগ। এসব খাদ্যশস্য ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয় এনজিওর মাধ্যমে।


অভিযোগ রয়েছে, অনেক এনজিও এসব খাদ্যশস্য এমন সব কর্মসূচিতে ব্যবহার করে যার সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক নেই। এসব খাদ্যশস্য পরিবহনের খরচের একটা বড় অংশ সরকারকে জোগাতে হলেও তা বিভিন্ন কর্মসূচিতে ব্যবহার করার আগে সরকারকে যথাযথভাবে জানানো হয় না। এ অবস্থায় খাদ্যশস্য কোথায় কিভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে, তার ব্যাপারে স্থানীয় সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তাগিদ দিয়েছে সরকার।
এদিকে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানিয়েছে, আগামী বছরগুলোতে খাদ্য-সহায়তা কমতে যাচ্ছে। কমতে শুরু করেছে বছর কয়েক আগে থেকেই। দুর্নীতি এর অন্যতম কারণ।
সূত্র জানায়, গত ২১ সেপ্টেম্বর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নির্বাহী বোর্ডের প্রতিনিধিদলকে সহায়তা বাড়ানোসহ খাদ্যশস্য ব্যবহারে সমন্বিত উদ্যোগের কথা বলেছেন খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক। ওই দিন ঢাকায় নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূত বিহঁজের জুঁসির নেতৃত্বে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রতিনিধিদল সচিবালয়ে খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে। প্রতিনিধিদল তাদের আগামী পাঁচ বছরের পরিকল্পনার কথা মন্ত্রীকে জানায়।
ড. রাজ্জাক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা থাকলে তা দূর করা হবে। তবে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো, উন্নয়ন সহযোগীদের খাদ্য-সহায়তা কমিয়ে দেওয়া। আমরা তাদের অনুরোধ করেছি খাদ্য-সহায়তা বাড়ানোর জন্য।'
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও বিলুপ্ত স্থানীয় সরকার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, এনজিওগুলো খাদ্য-সহায়তা ব্যবহার করে যে কাজ করে তার হিসাব যেমন সরকারের কাছে থাকে না তেমনি তাদের আয়ব্যয়ের কোনো তথ্যও সরকারের কাছে নেই। অনেক এনজিও এসব খাদ্যশস্য ব্যবহার করেই তাদের বিলাসবহুল অফিস বা যানবাহন সংগ্রহ করে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, সেভ দ্য চিলড্রেন, ইউরোপীয় কমিশন (ইসি), ইউএসএইড, অসএইড, জাপান, সুইডেনসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থা খাদ্য-সহায়তা হিসেবে বাংলাদেশে চাল, গম প্রভৃতি পাঠায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ সরকার নিজ ব্যয়ে এসব খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে। এ সহায়তা দিয়ে মূলত গ্রামীণ রাস্তাঘাট মেরামত করা হয়। স্কুল ফিডিং, ফিড ফর ফিউচার_এসব কর্মসূচিতেও উন্নয়ন সহযোগীদের দেওয়া খাদ্যশস্য
ব্যবহার করা হয়।
কর্মকর্তারা বলেন, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) উন্নয়ন সহযোগীদের খাদ্যশস্য ব্যবহার করে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। এনজিওগুলো এসব খাদ্যশস্য কোথায় কিভাবে বিতরণ করছে, তা জানে না সরকার। সংস্থাগুলো কোনো সমন্বিত নীতি অনুসরণ করে না। এসব খাদ্যশস্য ব্যবহার করে তারা যেসব রাস্তা মেরামত করে, সেগুলো আদৌ কোনো কাজে আসে না। প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক সময়ই দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এনজিও কেয়ার বা অন্য কোনো সংস্থা স্থানীয় মহিলাদের দিয়ে রাস্তা মেরামত করাচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে তারা এ কাজগুলো করছে। অপরিকল্পিতভাবে মাটি ফেলায় তা বৃষ্টিতে ধুয়ে-মুছে যায়। বেশির ভাগ সময় রাস্তার পাশ থেকে মাটি নিয়ে রাস্তায় ফেলা হয়। এসব কাজ করার সময় এনজিওগুলো সরকারের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করে না।
খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করেন, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাস্তা মেরামতের কাজ করা হলে তা স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। এতে খাদ্য-সহায়তা ব্যবহারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে বলেও তাঁরা মনে করেন।
দুস্থদের সহায়তার জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে ভিজিএফ (ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং) কর্মসূচি পরিচালনা করা হয়। জানা গেছে, সরকার যেখানে এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে, সেই একই এলাকায় বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির খাদ্য সহায়তার কার্যক্রম থাকলেও তার কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই। ফলে এ ধরনের কর্মসূচিতে দ্বৈততা পরিহার করা যাচ্ছে না। সরকার আইলাদুর্গত এলাকায় বিশেষ ভিজিএফ কর্মসূচি চালাচ্ছে। এসব এলাকায় বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির কার্যক্রমও রয়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি কাদের সহায়তা দিচ্ছে, তার তালিকা সরকারের কাছে নেই। এ তালিকা সরকারের কাছে থাকলে তারা নিজস্ব কর্মসূচি থেকে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির উপকারভোগীদের বাদ দিতে পারত। আরো কিছু দুস্থ পরিবার ভিজিএফ সহায়তা পেতে পারত।
একদিকে উন্নয়ন সহযোগীদের খাদ্য-সহায়তা কোথায় ব্যবহার করা হচ্ছে, তা যেমন সরকার জানে না, অন্যদিকে এসব সহায়তা দিন দিন কমছে। ১৯৯০-৯১ সালে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিসহ বিভিন্ন সংস্থা ১৬ লাখ টন খাদ্যশস্য বাংলাদেশে পাঠিয়েছে; বর্তমানে তা এক লাখ টনের নিচে নেমে গেছে। আগে বড় বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও বৈদেশিক খাদ্য-সহায়তা পাওয়া যেত নিয়মিতভাবে। আর বড় বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে তো কথাই ছিল না। ১৯৯৮-৯৯ সালে উন্নয়ন সহযোগীদের খাদ্য-সহায়তা ছিল সাড়ে সাত লাখ টন। ১৯৯৯-২০০০ সালে ছিল সাড়ে চার লাখ টন। গত অর্থবছরে খাদ্য-সহায়তা এসেছে এক লাখ ৬০ হাজার টন। চলতি বছর খাদ্য-সহায়তা গত বছরের চেয়েও কমেছে। এ অবস্থায় বিশ্ব খাদ্য সংস্থা তাদের সহায়তার পাঁচ বছরের পরিকল্পনা তৈরি করেছে। আগামী পাঁচ বছরে তারা বাংলাদেশে চার লাখ টন খাদ্যশস্য সহায়তা হিসেবে দেবে। এ হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ৮০ হাজার টন খাদ্য-সহায়তা পাবে বাংলাদেশ, যা বাংলাদেশে উন্নয়ন সহযোগীদের সর্বনিম্ন খাদ্য-সহায়তা। সরকার অবশ্য খাদ্য-সহায়তা বাড়ানোর জন্য সহযোগীদের অনুরোধ জানিয়েছে।
খাদ্য-সহায়তা কমে যাওয়ার কারণ কী, জানতে চাইলে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আগে আমাদের দেশে অভাব একটি নিত্য বিষয় ছিল। এখন পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। উন্নয়ন সহযোগীরা আফ্রিকার দুর্ভিক্ষ-পীড়িত দেশগুলোতে এখন খাদ্য-সহায়তা বেশি পাঠায়। এটাই খাদ্য-সহায়তা কমার বড় কারণ। এ ছাড়া উন্নয়ন সহযোগীরা তাদের কৌশলেও পরিবর্তন এনেছে। আগে তারা সদস্য দেশগুলোর খাদ্য-নিরাপত্তার কথা ভাবত। খাদ্য উৎপাদনের ওপর জোর দিত। এখন তারা খাদ্য উৎপাদনের চেয়ে দেশে দেশে সুশাসনের কথা বেশি বলে।'
খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, 'আশির দশকে তাদের বাজেটের ১৮ শতাংশই ব্যয় হতো কৃষি উন্নয়নে। বর্তমানে সেটা ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। কৃষির ওপর তাদের বিনিয়োগ কমার কারণেই ২০০৭-০৮ সালে সারা বিশ্বে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। তখন দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল। তাদের কাছে পর্যাপ্ত টাকা থাকার পরও তারা খাদ্য কিনতে ব্যর্থ হয়। সেই সময় বাংলাদেশে খাদ্যমূল্যে রেকর্ড সৃষ্টি হয়। অবশ্য পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উন্নয়ন সংস্থাগুলো তাদের কৌশলে পরিবর্তন এনেছে। তারা আবার কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। ২০০৭-০৮ সালের বিশ্ব খাদ্য সংকট তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য করে।
খাদ্য-সহায়তা কমার আরেকটি কারণ হচ্ছে দুর্নীতি। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি উন্নত মানের গম পাঠালেও ভোক্তাদের হাতে যেত নিম্ন মানের গম। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির গম চলে যেত ব্যবসায়ীদের হাতে। একটি সিন্ডিকেট এসব গম বদলে ফেলত। দুর্নীতির এ খবর জানার পর ডাবি্লউএফপি খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.