কঞ্চি বাঁধি পাখা বাঁধি সঙ্গে বাঁধি স্বপ্ন by জিয়াউল হাসান পলাশ

'আমার সংসার আমারই দেখতে হবে। উপায় যে নাই! এখন আর পুরুষ-মহিলা বলতে কোনো কথা আমাগো গ্রামে নাই। স্বামী দীর্ঘদিন অচল। দুই মাইয়া ঢাকায়। একটা পোলা ক্লাস ফাইভে পড়ে। স্বামী সংসার, পোলার খরচ আমি ছাড়া কে চালাবে। কাজ করুম না খামু কী? কাজ না করলে ভালোও লাগে না। বারো মাস কাজ করি। সংসার চলে মোটামুটি'_ কী করেন, কীভাবে সংসার চলছে জানতে চাইলে একবারেই কথাগুলো বলেন ঝালকাঠির কীর্তিপাশা ইউনিয়নের শশাঙ্ক গ্রামের ষাট ছুঁই ছুঁই বয়সের নূরজাহান বেগম।

অভাবকে জাদুঘরে পাঠানোর স্বপম্ন তিনি দেখেন না ঠিকই কিন্তু অভাবের সঙ্গে লড়াই করে একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার আশা প্রতিনিয়ত তার। শশাঙ্ক গ্রামের কারিগর বাড়ি এক নামেই পরিচিত। বিশেষ করে হাকিম আলী কারিগরের বাড়ি। এ বাড়িতে ছোট-বড় ছয়টি ঘর। এসব ঘরের নারীরা বারো মাসই কাজ করে আয় করছেন। জীবনযুদ্ধে পরাজয় মানতে রাজি নন এ বাড়ির এমনই এক গৃহিণী নূরজাহান। পক্ষাঘাত রোগে স্বামী প্রায় চার বছর ধরে অচল। দুই মেয়ে ঢাকায় থাকে। একমাত্র ছেলে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। স্বামী-সংসার এবং ছেলের পড়াশোনার খরচ নূরজাহান একাই বহন করছেন। পুঁজি না থাকলেও বারো মাসই কাজ করে খরচ জুগিয়ে সংসারের হাল ধরে রেখেছেন তিনি। বিশেষ করে ফাল্কগ্দুন-চৈত্র-বৈশাখ ও জৈ্যষ্ঠ_ গরমের এ চার মাস তালপাখা তৈরির কাজ করেন। মজুরির বিনিময়ে তৈরি করা এসব পাখা ঝালকাঠি ও আশপাশ এলাকার মেলাগুলোতে বিক্রি হয়। তালপাখার প্রচুর চাহিদা থাকায় নূরজাহানেরও কাজের চাহিদা থাকে এ চার মাস। কীভাবে মজুরি পান জানতে চাইলে নূরজাহান বলেন, পুঁজি না থাকায় আমি পাখা তৈরির সব জিনিসপত্র কিনতে পারি না। তাই যারা এগুলো কিনে দেয় তাদের পাখা তৈরিতে সহযোগিতা করি। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে এক শ' তালপাখা বেঁধে দিলে প্রতিদিন মজুরি পাই কুড়ি টাকা। দিনে এক শ'র বেশি পাখা বাঁধা যায় না। কারণ সংসারের রান্না আর অচল স্বামীর সেবা করতে হয়। দিনে কুড়ি টাকা করে মাসে ৬ শ' টাকা আসে। এই টাকা ছেলের স্কুলের পড়াশোনার খরচ, সংসারের ডাল, তেল, লবণ, চাল কিনতেই লাগে।' বছরের বাকি আট মাস তিলের নাড়ূ, বাদাম, বুট, চিঁড়ার মোয়া তৈরি করে স্থানীয় দোকানে বিক্রি করে মোটামুটি চলেন নূরজাহান।
নূরজাহান বলেন, অভাব আমাদের নিত্যসঙ্গী। এ কাজ করে একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার স্বপম্ন দেখি প্রতিদিন। এ বাড়িতে আটজন মহিলা বারো মাস এভাবে কিছু না কিছু করে আয় করছে। তবে নূরজাহান ছাড়া অন্য সবার স্বামী সচল। তাই তাদের স্বামীরাও অর্থ উপার্জন করে। কিন্তু নূরজাহান একাই তার পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তিরিশ বছর ধরে পাখা তৈরির পাশাপাশি অন্যান্য কাজ করে খুঁজে পান তিনি বেঁচে থাকার প্রেরণা। স্বপম্ন দেখেন ছেলেকে পড়ালেখা করিয়ে বড় চাকরি করাবেন। তাই পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ূয়া একমাত্র ছেলে দুলালই এখন নূরজাহানের শেষ ভরসা। নূরজাহান যখন কাজ করে বয়সের ভারে স্বামীর মতো অচল হয়ে যাবেন তখন দুলাল তাকে রোজগার করে খাওয়াবে। আর তাই নূরজাহান এ বয়সেও বারো মাস কাজ করে যতদূর সম্ভব ছেলেটাকে পড়াশোনা করাচ্ছেন। নূরজাহানের বিবাহিত এক মেয়ে তার স্বামী-সংসার নিয়েই ঢাকা থাকেন। তার মাকে টাকা দেওয়ার কোনো সামর্থ্য নেই। তবে গার্মেন্টসে কাজ করা অপর মেয়েটি মাঝে মধ্যে কিছু টাকা দিলেও তা সংসারের প্রয়োজনেই ব্যয় করেন নূরজাহান।

No comments

Powered by Blogger.