আর্থিক সংকটে বিমান by টিপু সুলতান

টানা লোকসানের কারণে আর্থিক সংকটে পড়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। এখন দৈনন্দিন পরিচালন ব্যয় মেটানো নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে আছে বিমান কর্তৃপক্ষ। বিমান সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানটি গত অর্থবছরে লোকসান দিয়েছে ১৯৫ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে লোকসান দিয়েছিল ৮০ কোটি টাকা। তার ওপর বিমানের দেনা আছে ২০০ কোটি টাকা। এই অবস্থায় ডিসেম্বর থেকে প্রতি তিন মাস অন্তর ৬০ কোটি টাকা করে বোয়িং থেকে উড়োজাহাজ কেনার কিস্তি দিতে হবে।

আর্থিক এ দুরবস্থার মধ্যেও প্রতিষ্ঠানটিতে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি চলছে বলে অভিযোগ আছে। অভিযোগ তুলেছে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও। কমিটির গত মাসের সভায় বিমানের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়। এর মধ্যে আবার বিমানের বিদেশি শাখাগুলোতে বড় ধরনের আর্থিক দুর্নীতি ধরা পড়েছে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের নিরীক্ষা ও বিমানের অভ্যন্তরীণ তদন্তে। ওমানে টিকিট বিক্রিসহ বিভিন্ন খাতে দুই বছরে ১০ কোটি টাকার দুর্নীতি নিরীক্ষায় ধরা পড়েছে। কিন্তু বিমান কর্তৃপক্ষ এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এ ঘটনা এখন সংসদীয় কমিটি তদন্ত করেছে।
তদন্ত কমিটির প্রধান ও জাতীয় সংসদের হুইপ মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, কমিটির পক্ষ থেকে বিমানের কাছে কিছু তথ্য-উপাত্ত চাওয়া হয়েছে। সেগুলো হাতে পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
অবশ্য একই রকম দুর্নীতির অভিযোগে সৌদি আরবের রিয়াদ, কুয়েত ও ব্যাংকক থেকে অভিযুক্ত চারজন কর্মকর্তাকে ইতিমধ্যে প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে বিমান সূত্র জানিয়েছে।
বিমানের জন্য উড়োজাহাজ ভাড়ায়ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কমিটি সূত্র জানায়, গত ৮ সেপ্টেম্বর সংসদীয় কমিটির সভায় বিমানের বোয়িং ৭৪৭ উড়োজাহাজ ইজারা নেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুললে বিমানমন্ত্রী জি এম কাদের বলেছেন, তিনিও মনে করেন, এ ক্ষেত্রে কিছু অনিয়ম হয়েছে। সভায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিমান বাংলাদেশ জবাবদিহি ছাড়াই চলছে।
বিমান কর্তৃপক্ষ তাদের বিদেশি শাখায় অনিয়ম-দুর্নীতির কথা স্বীকার করলেও বিমান ভাড়াসহ কেনাকাটায় দুর্নীতির কথা মানতে নারাজ।
প্রথম আলোর কাছে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এয়ার কমোডর (অব.) জাকীউল ইসলাম দাবি করেন, বিমানের ক্রয় নীতিমালা অনুসরণ করেই উড়োজাহাজ ভাড়া করাসহ সব ধরনের কেনাকাটা করা হয়েছে।
সরকারের কাছে ২৫০০ কোটি টাকা চেয়ে সাড়া মেলেনি: বিমানের একাধিক সূত্র জানায়, আর্থিক সংকট সামাল দিতে বিমানের পক্ষ থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে সরকারের কাছে দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার তহবিল চাওয়া হয়েছে। তাতে এখন পর্যন্ত সাড়া পাওয়া যায়নি।
তহবিল সংকট এবং এ কারণে অনানুষ্ঠানিকভাবে সরকারের কাছে অর্থ চাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন বিমানের এমডি জাকীউল ইসলাম। তিনি বলেন, সম্প্রতি খরচ বেড়েছে অনেক। তার ওপর বোয়িং থেকে নতুন কেনা উড়োজাহাজের জন্য ৮০ জন প্রকৌশলীকে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়েছে। তাঁদের যাতায়াত ও থাকা-খাওয়া বাবদও বিশাল খরচ হয়েছে। এ ছাড়া জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় রাজস্ব আয় কমেছে।
এখন বিমানের এই শীর্ষ কর্মকর্তার একমাত্র আশা, নতুন কেনা দুটি বোয়িং-৭৭৭ দিয়ে ইউরোপে বিরতিহীন ফ্লাইট। তা থেকে বড় ধরনের রাজস্ব পাওয়ার আশা করছেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি এ-ও বলেছেন, ওই আয় থেকে প্রতি তিন মাস অন্তর ৬০ কোটি টাকা করে বছরে ২৪০ কোটি টাকা ঋণের কিস্তিও পরিশোধ করতে হবে বিমানকে।
নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ দুটি নিয়ে বড় ধরনের রাজস্ব আয়ের স্বপ্ন দেখলেও এ জন্য বিপণন ও বিক্রয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো উদ্যোগ বা কার্যক্রমের ঘাটতি রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন।
বিমান ভাড়ায় দুর্নীতির অভিযোগ: বহর পরিকল্পনা শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে এক বছরের জন্য একটি বোয়িং-৭৪৭ ভাড়া করা হয়েছে। এর ভাড়া প্রতি উড্ডয়ন ঘণ্টা ছয় হাজার ৪৯৫ মার্কিন ডলার। আইন অনুযায়ী, ২০ বছর বা ততোধিক পুরোনো উড়োজাহাজ আনার সুযোগ নেই। কিন্তু এ বোয়িংটি ঢাকায় আনার এক সপ্তাহের মধ্যে বয়স ২০ বছর হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে বিমান কর্তৃপক্ষের যুক্তি হলো, যেদিন উড়োজাহাজটি ঢাকায় এসে বহরে যুক্ত হয়, ওই দিন এটির বয়স ২০ বছর হয়নি। আইন অনুযায়ী, ওই দিন বহরে যুক্ত হতে বাধা ছিল না।
সূত্রগুলো আরও জানায়, উড়োজাহাজটিতে অনেক ত্রুটি ছিল। তড়িঘড়ি করে আনতে গিয়ে সেটি একবার বিকল হয়ে যায়। পরে মেরামত করে ঢাকায় আনা হয়। এরপর সেটি দিয়ে হজ ফ্লাইট শুরুর এক দিন পরই ত্রুটি দেখা দেয়। তাই ১ অক্টোবরের একটি ফ্লাইটের হজযাত্রীদের প্রায় ১৪ ঘণ্টা বিমানবন্দরে দুর্ভোগে পড়তে হয়। এ উড়োজাহাজটি ভাড়া করার ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে সংসদীয় কমিটি।
জানতে চাইলে বিমানের এমডি বলেন, যেহেতু তদন্ত চলছে, তাই এ বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে অপারগ। তিনি বলেন, এ-সংক্রান্ত সব কাগজপত্র ইতিমধ্যে সংসদীয় তদন্ত কমিটিকে দেওয়া হয়েছে। এটি বহরে যুক্ত হওয়ার পর ২১ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর আটটি ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়েছে। এরপর ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে হজ ফ্লাইট পরিচালনা করা হচ্ছে।
সাড়ে ১৬ কোটি টাকার খবর নেই: বিমানে দুর্নীতির অভিযোগের মতো অদক্ষ ব্যবস্থাপনার বদনামও পুরোনো। সম্প্রতি এর আরেকটি নজির মিলেছে।
বিমান গত বছর ইউরো আটলান্টিক এয়ারলাইনস থেকে এক বছরের জন্য একটি বোয়িং-৭৭৭ উড়োজাহাজ ভাড়া করে। চুক্তি শেষে সেটি গত ৪ ফেব্রুয়ারি ফেরত যায়। এর কয়েক মাস পর বিমান কর্তৃপক্ষ টের পায় নিরাপত্তা জামানত বাবদ দেওয়া এক মাসের আগাম ভাড়া ২২ লাখ মার্কিন ডলার অর্থাৎ সাড়ে ১৬ কোটি টাকা রয়ে গেছে পর্তুগালভিত্তিক ইউরো আটলান্টিকের কাছে। এ টাকা ফিরে পেতে সেই থেকে তাদের পিছে দৌড়াচ্ছে বিমান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানের হিসাব শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত শেষ মাসের ভাড়ার টাকা পরিশোধ করার আগে নিরাপত্তা জামানতের টাকা সমন্বয় করার কথা। কিন্তু বিমানের সংশ্লিষ্ট শাখার দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা তা করেননি। বিষয়টি জানার পর গত জুনে কর্তৃপক্ষ ইউরো আটলান্টিকের কাছে ২২ লাখ ডলার ফেরত চায়। কিন্তু কোম্পানিটি নানা যুক্তি দেখাচ্ছে। বলছে, তাদের উড়োজাহাজের বিভিন্ন ক্ষতি হয়েছে, সেটা মেরামতে এ টাকা ব্যয় হয়েছে।
বিমানের এমডি জাকীউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ইউরো আটলান্টিক যতই যুক্তি দেখাক, বিমানের পাওনা সঠিক। তিনি বলেন, ‘আমরা আরবিট্রেশনে যাব। আইনিভাবে আমরা ঠিক আছি। আর ইউরো আটলান্টিকও এখন আলোচনায় আসতে চায়।’
বিমানের এই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন আমরা ধাক্কা খেয়ে শিখেছি, ভবিষ্যতে জাহাজের লিজের শেষ মাসের ভাড়া বাবদ নিরাপত্তা জামানত থেকে কেটে রাখা হবে।’
লোকসান অব্যাহত: বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কোম্পানিতে রূপান্তরের পর লাভের মুখ দেখে বিমান। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবার ক্রমাগত লোকসান দিয়ে যাচ্ছে শত ভাগ সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটি। জাতীয় সংসদে বিমানমন্ত্রীর উত্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম অর্থবছরে বিমান লোকসান দেয় ৮০ কোটি টাকা। লোকসানের কারণ ব্যাখ্যার জন্য বিমানকে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ নোটিশ দিয়েছে। বিমানের দেওয়া ব্যাখ্যায় মন্ত্রণালয় সন্তুষ্ট হতে পারেনি। আবারও ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
অবশ্য অনেক পরে বিমান কর্তৃপক্ষ দাবি করে, তাদের হিসাবে ভুল ছিল। প্রকৃতপক্ষে ওই অর্থবছরে লোকসান হয়েছে ২৫ কোটি টাকা। এরপরের অর্থাৎ গত অর্থবছরও বিমান লোকসান দিয়েছে। বিমানের এমডির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, লোকসানের পরিমাণ ১৯৫ কোটি টাকা।
বিমানের হিসাব শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, ২০১১-১২ অর্থবছরে লোকসানের পরিমাণ আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন তাঁরা।

No comments

Powered by Blogger.