’৭১-এর গণহত্যার বিচার সামনে অনেক বাধা by শাহরিয়ার কবির

ট্রাইব্যুনালের বহু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ও দলিল কীভাবে বাইরে পাচার হয়েছে এ নিয়েও কোনো তদন্ত হয়নি। ট্রাইব্যুনাল গঠনের সময় কেন জামায়াতের একজনকে প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, কে কার সুপারিশে বা নির্দেশে তাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন এ নিয়ে আমরা তদন্ত দাবি করেছিলাম ট্রাইব্যুনালের সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে।
নিরাপত্তা বলতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিচারক বা আইনজীবীদের গানম্যান দেয়া ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেন না। এই ‘গানম্যান’দের ভেতর জামায়াতের রোকন আছে কিনা এটি জানার দায়িত্ব কারও নেই। ২০১১ সালে পাকিস্তানে পাঞ্জাবের গবর্নর সালমান তাসিরকে তার মৌলবাদী গানম্যানই হত্যা করেছিল। কিছুদিন আগে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার জেনেছেন তাঁর একজন গাড়িচালক ছিল জামায়াতের রোকন।
ট্রাইব্যুনালে কমপক্ষে ৫০টি সিসিটিভি ক্যামেরা ও ১০ জন অপারেটর প্রয়োজন। বর্তমানে ক্যামেরা আছে ১৬টি কিন্তু কোন অপারেটর নিয়োগ দেয়া হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দু’জন অফিসকালে এসে একটি মনিটরে গোটা ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ করেন।
সরকারের কোন কোন মন্ত্রী বা নেতা এসব নিয়ে কথা বলায় উল্টো আমাদের অজ্ঞতার সমালোচনা করেনÑ নাকি আমরা হতাশা সৃষ্টি করছি। এই ট্রাইব্যুনাল ও বিচারকে কেন ফৌজদারি আদালতের মতো মামুলি বিষয় বিবেচনা করা হচ্ছে এর মাহাত্ম্য অনুধাবন আমাদের মতো অজ্ঞজনদের উপলব্ধির অতীত। নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে প্রথম দফায় ২১ জন ব্যক্তি ও ৭টি সংগঠনের বিচারের জন্য প্রসিকিউশনের সদস্য এবং তাদের সহকারীদের সংখ্যা ছিল হাজারের কোটায়, অথচ আমাদের ট্রাইব্যুনালে সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত পূর্ণকালীন এক ডজন আইনজীবীও নেই। মিডিয়া সেল, গবেষণা সেল, লাইব্রেরি ও আর্কাইভের অভাবের কথা বলে বলে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তদন্ত সংস্থার অর্গানোগ্রাম প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে অনুমোদন করা হলেও জনপ্রশাসন ও আইন মন্ত্রণালয়ের আপত্তির কারণে এটি অর্থ মন্ত্রণালয় অবধি এসে স্থবির হয়ে গেছে। তদন্ত সংস্থার সঙ্গে প্রসিকিউশনের এবং প্রসিকিউশনের ভেতরকার সমন্বয়হীনতার জন্য কে বা কারা দায়ী, কীভাবে এ সমস্যার সমাধান হবে এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কোন উদ্বেগ আছে বলে মনে হয় না। সরকার পক্ষের সাক্ষীরা একের পর এক গুম হয়ে যাচ্ছেন, ট্রাইব্যুনালে আসতে ভয় পাচ্ছেনÑ এত বলার পরও এখন পর্যন্ত সাক্ষী নিরাপত্তা আইনটি তৈরি হয়নি।
ট্রাইব্যুনালের ভেতর জামায়াত শুরু থেকেই কালক্ষেপণের কৌশল অবলম্বন করেছে। আইনে সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও ১ নম্বর ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের পদত্যাগের পর মামলার পুনঃ শুনানির জন্য আসামি পক্ষ যেভাবে আদালতের সময় নষ্ট করেছে তাতে জামায়াতের স্বার্থসিদ্ধি হলেও বিচার বিলম্বিত হয়েছে, ট্রাইব্যুনালের মর্যাদা ক্ষুণœ হয়েছে। এ বিষয়ে প্রসিকিউশনের অবস্থান ছিল অত্যন্ত দুর্বল। এত স্বল্প সংখ্যক আইনজীবীর পক্ষে জামায়াতের বিশাল ডিফেন্স বহর মোকাবেলা সম্ভব নয়।
জামায়াতের ভা-ারে বিপুল অর্থ আছে আমরা জানি, কিন্তু এই অর্থের উৎস আমরা জানি না। ওয়াশিংটনের ‘ক্যাসেডি এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটস’কে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে দেনদরবার করবার জন্য জামায়াত নেতা ও ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মীর কাশিম আলী যে ২৫ মিলিয়ন ডলার দিলেন এ নিয়ে কোন তদন্ত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। খালেদা জিয়ার আমলেও জঙ্গী সম্পৃক্ততার জন্য ইসলামী ব্যাংককে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। এ সরকারের আমলে সরকারের উন্নয়নের সহযোগী হয়েছে জামায়াতের এই প্রধান ব্যাংক, যার বিরুদ্ধে জঙ্গীদের অর্থ আদান-প্রদানের বহু তথ্য প্রমাণ বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
’৭১-এর গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচার করা হবে আর জামায়াত ঘরে বসে তা দেখবে? যারা ভাবছেন দলের বিচার না করলে জামায়াত কিছু করবে না তারা আহাম্মকের স্বর্গে বাস করছেন। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচার করা হবে অথচ জামায়াতের বিচার ঠিক হবে না এমন বিবেচনা কেউটে সাপের লেজ দিয়ে কান চুলকানোর মতো বিপজ্জনক।
আমরা গত ২১ বছর ধরে বলছি ’৭১-এর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনেরও বিচার করতে হবে এবং জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। জামায়াতপন্থী বুদ্ধিজীবীরা টেলিভিশনের টক শো’-এ বলেন, এই দাবি নাকি অগণতান্ত্রিক, নিষিদ্ধ করলে জামায়াত ও জঙ্গীরা আরও শক্তিশালী হবে, এতে নাকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এ সব অপযুক্তি সম্ভবত সরকারের নীতি নির্ধারকদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে। মাননীয় আইনমন্ত্রী যখন বলেন, আমরা এই ট্রাইব্যুনালে শুধু ব্যক্তির বিচার করব, সংগঠনের বিচার করব না তাতে জামায়াত সন্তুষ্ট হতে পারে, কিন্তু সংগঠনের বিচার না করলে ৩০ লাখ শহীদদের পরিবার ও স্বজনদের বঞ্চিত করা হবে ন্যায়বিচার থেকেÑএই সত্যটি মন্ত্রীরা বুঝতে চান না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের পরিবারের ৯৯ ভাগ সদস্য বলতে পারবেন না কোন ব্যক্তি তাদের প্রিয়জনদের হত্যা করেছে। তারা জানেন হত্যাকারীরা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী, জামায়াতে ইসলামী, শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর বা আলশামসের মতো ঘাতক সংগঠনের সদস্য। গো. আযম গং ’৭১-এ যেসব অপরাধ করেছেন সেগুলো ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত বা পারিবারিক শত্রুতাবশত ছিল না। ’৭১-এর গণহত্যা ঘটেছে পাকিস্তানী সরকার এবং কয়েকটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। গো. আযমরা মওদুদীর রাজনীতি ও দর্শন অনুযায়ী এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছেন।
২০১৩ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোটের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন কীভাবে হবে এর মীমাংসা যদি হয়ওÑশীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি যদি নির্বাচনের আগে নিশ্চিত না হয় তার মাশুল শুধু মহাজোটকে নয়, গোটা জাতিকে দিতে হবে। যাদের বিচার শুরু হয়েছে সেগুলো যদি এ সরকারের মেয়াদকালে শেষ না হয় বাংলাদেশে আর কখনও তা সম্ভব হবে না। এই বিচার নিয়ে প্রথম দিকে দেশে ও বিদেশে মানুষের যে আগ্রহ ছিল তাতে এখন ভাটা পড়েছে প্রধানত সরকারের নীতিনির্ধারকদের উপলব্ধির অভাবে। জামায়াতের অপপ্রচারে এবং বিচারবিরোধী ষড়যন্ত্র ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ে মানুষ যেমন ক্ষুব্ধ, একইভাবে ক্ষুব্ধ জঙ্গী সম্পৃক্তি এবং ’৭১-এর গণহত্যার সঙ্গে সম্পৃক্তির অপরাধে জামায়াতের বিচার না হওয়ায়।
গত ৬ জানুয়ারি মহাজোট সরকারের চতুর্থ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ‘প্রথম আলো’য় বিভিন্ন বিষয়ে যে জনমত জরিপের ফল প্রকাশিত হয়েছে তার ভেতর দুটি হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ সম্পর্কে। ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বর্তমান সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারছে কি?’ এ প্রশ্নের জবাবে ২০০৯ সালে উত্তরদাতাদের ৮৬% ‘হ্যাঁ’ বলেছেন, ২০১২ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৪%-এ। ট্রাইব্যুনালের লোকবল, রসদ ও নিরাপত্তার ঘাটতি যদি অব্যাহত থাকে, জামায়াতের বহুমাত্রিক চক্রান্ত সম্পর্কে সরকার যদি আগের আগের মতো উদাসীন থাকেÑ২০১৩ সালে সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা এ ক্ষেত্রে কোথায় এসে দাঁড়াবে ভেবে শঙ্কাবোধ করছি।
‘প্রথম আলো’র জরিপে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের পক্ষে ৫৮% উত্তরদাতা ‘হ্যাঁ’ বলেছেন, ৪১% বলেছেন ‘না’। যদি নির্দিষ্টভাবে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের কথা বলা হতো আমি মনে করি অন্ততপক্ষে ৮০% উত্তরদাতা ‘হ্যাঁ’ বলতেন। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের বহু ধর্মীয় সংগঠন এবং আলেম-ওলামারা মনে করেন জামায়াত রাজনীতির নামে ইসলাম ধর্মকে কলঙ্কিত করছে। জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ওপর যদি গণভোট হয় এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সিংহভাগ মতো হবে নিষিদ্ধকরণের পক্ষে। তবে ’৭১-এর গণহত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার দায়ে জামায়াতের বিচারের জন্য গণভোটের প্রয়োজন নেই। নির্বাচকম-লী ২০০৮-এর নির্বাচনেই এই ম্যান্ডেট মহাজোটকে দিয়েছে। আমজনতা যা চান সরকারের বিজ্ঞ নীতিনির্ধারকরা যদি তা না বোঝেন তাহলে বুঝতে হবে সর্বনাশের আর বাকি নেই।
(সমাপ্ত)

No comments

Powered by Blogger.