সোনারচর- সাগর ও সবুজ যেখানে একাকার

প্রকৃতির এক অপরূপ সৃষ্টি সোনারচর। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার দক্ষিণ সীমানায় বঙ্গোপসাগরের একেবারে কোল ঘেঁষে এর অবস্থান। এখানে সবুজ প্রকৃতি, বন্যপ্রাণী, পাখির ঝাঁক, জেলেদের উচ্ছ্বাস আর সাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশি মিলে নয়নাভিরাম এক সৌন্দর্যের জগত সৃষ্টি হয়েছে।
সাগরে যখন জোয়ারের পানি উথলে ওঠে তখন অনন্য এক সৌন্দর্য বিকশিত হয় সোনারচরে। তটরেখায় আছড়ে পড়ে ছোট-বড় ঢেউ। প্রায় দশ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং পাঁচ কিলোমিটার প্রস্থের সমুদ্র সৈকতের যে কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার রয়েছে সুযোগ। ঢেউয়ের তালে তালে দুলতে থাকা জেলে নৌকার বহর। সাগরে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য। এমন মনোরম পরিবেশ কার মন না টানে? বিশেষ করে প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এর আবেদন অন্য রকমের।যে কারণে নাম হলো সোনারচর সোনারচরে সোনা নেই, আছে সোনা রঙের বালি। সকাল কিংবা শেষ বিকেলের রোদের আলো যখন সোনারচরের বেলেভূমিতে পরে, তখন দূর থেকে পুরো দ্বীপটাকে সোনালি রঙের থালার মতো মনে হয়। বালুর ওপরে সূর্যের আলোয় চোখের দৃষ্টি চিক চিক করে। মনে হবে যেন কাঁচা সোনার প্রলেপ দেয়া হয়েছে দ্বীপটিতে। ধারণা করা হয়, বিশেষ এ বৈশিষ্ট্যের কারণেই দ্বীপটির নাম রাখা হয়েছে সোনারচর। আবার কারও কারও মতে এক সময়ে দ্বীপটিতে প্রচুর সোনালি ধান জন্মাত, সে কারণেই এর নাম সোনারচর।

যে পথে যেতে হবে

সোনারচরে যাতায়াতে একাধিক পথ রয়েছে। দেশের যে কোন অঞ্চল থেকে পটুয়াখালী আসার ব্যবস্থা রয়েছে। ঢাকা থেকে আছে বাস ও লঞ্চের ব্যবস্থা। পটুয়াখালী থেকে প্রথমে গলাচিপা উপজেলা সদর এবং এখান থেকে সড়কপথে দশ কিলোমিটার দক্ষিণে পানপট্টি লঞ্চঘাট। সেখান থেকে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারযোগে আগুনমুখা মোহনা পেরিয়ে দক্ষিণে ডিগ্রি নদীর বুক চিরে একটু বাঁয়ে যেতেই আরেকটি নদীÑ বুড়াগৌরাঙ্গ। সামনে গিয়ে বাঁক ঘুরতেই দাঁড়ছিড়া নদী। দু পাশে ঘন ম্যানগ্রোভ গাছের বাগান। বিভিন্ন প্রজাতির পাখির ডাক, নদীর বুক জুড়ে গাঙশালিকের অবাধ বিচরণ। সামুদ্রিক হাওয়ার মৃদুমন্দ ছোঁয়া। সব মিলিয়ে এক অন্য রকম ভালোলাগার অনুভূতি সোনারচরের যাত্রা পথে। ট্রলার কিংবা লঞ্চযোগে আগুনমুখার মোহনা থেকে ঘণ্টা দুয়েক এগুলেই চোখে পড়বে মায়াবী দ্বীপÑ চর তাপসী। তাপসীর বাঁকে পৌঁছাতেই সোনারচরের হাতছানি। তাপসী থেকে ৩০ মিনিটের পথ দক্ষিণে এগুলেই সোনারচর।
স্পিড-বোট নিয়েও যাওয়া যেতে পারে সোনারচরে। গলাচিপা লঞ্চঘাট থেকে স্পিড বোটে সোনার চরে যেতে সময় লাগে মাত্র দেড় ঘণ্টা। আবার কুয়াকাটা থেকেও সোনারচরে যাওয়া যেতে পারে। যেতে হবে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে। ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে সময় লাগবে ঘণ্টা তিনেক। দক্ষিণের আরেক জেলা ভোলা থেকেও সোনারচরে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে সে পথ যথেষ্ট দুর্গম। নদীপথে সময় লাগবে কমপেক্ষ ৬ থেকে ৭ ঘন্টা।

যা দেখবেন

সোনারচরে রয়েছে প্রায় দশ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং পাঁচ কিলোমিটার প্রস্থের বিশাল সমুদ্র সৈকত। সৈকতের যে কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার রয়েছে অপূর্ব সুযোগ। এখানে রয়েছে পাঁচ হাজার একরের বিশাল বনভূমি। প্রশাসনের দেয়া তথ্য মতে, সুন্দরবনের পরেই আয়তনের দিক থেকে এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। সোনারচরের বিশাল বনভূমির মধ্যে ছড়িয়ে আছে দেড় শতাধিক ছোট-বড় খাল। ছোট্ট নৌকা বা ইঞ্জিন চালিত ট্রলার নিয়ে এসব খালে ভেসে ভেসে দেখা যায় বিচিত্র সব পাখপাখালির বিচরণ। বনবিভাগের দেয়া তথ্যে জানা যায়, বহু হরিণ আর বানর রয়েছে সোনারচরে। তবে ঘন অরণ্যের কারণে এগুলোর দেখা মেলে খুব কম। বনাঞ্চলের কাছাকাছি গেলে হয়তো সহজেই চোখে পড়বে বুনো মোষ। দেখা মিলবে বুনো গরুর। এসব গরু-মোষ দলছুট হয়ে বুনো হিংস্র পশুতে পরিণত হয়েছে। এর বাইরে এখানে রয়েছে শূকর, বানর, মেছো-বাঘসহ আরও বিচিত্র সব বন্য প্রাণী। মনমুগ্ধকর সৌন্দর্যের নানা রকম প্রাকৃতিক আয়োজন রয়েছে এ দ্বীপটিতে। শীতের সময় বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির অভয়ারণ্যে পরিণত হয় পুরো দ্বীপ ও পার্শ্ববর্তী এলাকা। সোনারচর বনাঞ্চলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ম্যানগ্রোভের পাশাপাশি নানান জাতের গাছপালার বাগান করা হয়েছে। যা কারও দৃষ্টি কাড়বে। রয়েছে সমুদ্র উপভোগের সুযোগ। ঢেউয়ের তালে সমুদ্র স্নানেও রয়েছে ভিন্ন আমেজ। এখানে গেলে দেখা মিলবে হাজারো জেলের। সাগর থেকে তুলে আনা টাটকা মাছের স্বাদও নেয়া যাবে এখান থেকে। শুঁটকিপল্লীতেও ঘুরে বেড়ানো যাবে। দেখা যাবে লালকাঁকড়া যেন চাদর বিছিয়ে রেখেছে। মোট কথা একদিকে দূর আকাশ বিস্তীর্ণ সাগর এবং বনাঞ্চল। দু’টোরই স্বাদ মিলবে সোনারচরে। সে সঙ্গে বন্যপ্রাণী আর পাখির কলরবে প্রকৃতির সৌন্দর্য পিপাসুরা সোনার চরের রূপে মুগ্ধ হবেনই।

যেখানে থাকবেন

সোনারচরে রাত কাটানোর মতো নিরাপদ আরামদায়ক কোন ব্যবস্থা এখনও গড়ে ওঠেনি। তবে গলাচিপা উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সোনারচরে পর্যটকদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ছোট্ট তিন কক্ষের একটি বাংলো। ইচ্ছে করলে রাতে সেখানে থেকে যেতে পারেন। এছাড়া, রয়েছে বনবিভাগের ক্যাম্প। সেখানে কিছুটা কষ্ট হলেও রয়েছে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা। চাইলে সূর্যাস্ত দেখার পর ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলারে ৩০ মিনিটে চলে যেতে পারেন চরমোন্তাজে। সেখানে রয়েছে বন বিভাগ, বেসরকারি সংস্থা স্যাপ বাংলাদেশ ও মহিলা উন্নয়ন সমিতির ব্যবস্থাপনায় রাত যাপনের মতো মোটামুটি সুবিধা সম্পন্ন বাংলো। রয়েছে হোটেল। চরমোন্তাজে রাত কাটিয়ে সোনারচরের পাশেই মৌডুবী, জাহাজমারা, তুফানিয়া ও শিপচরসহ আরো কয়েকটি দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ রয়েছে। এর সব দ্বীপই সাগরের বুক চিরে জেগে ওঠা। মোট কথা দু’ তিনদিন ঘুরে বেড়িয়ে সোনারচরসহ আশপাশের দ্বীপগুলো দেখে ফিরতে পারেন।

সরকারী উদ্যোগ-আয়োজন

সোনারচরকে আধুনিক পর্যটন কেন্দ্রে রূপ দেয়ার উদ্দেশ্যে সরকারী পর্যায়ে নেয়া হয়েছে নানামুখী উদ্যোগ-আয়োজন। ১৯৯৮ সালে কুয়াকাটা পর্যটনকেন্দ্র উদ্বোধনকালে তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোনারচর থেকে শুরু করে কুয়াকাটা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে ‘একান্ত পর্যটন জোন’ গড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরই বাস্তব রূপ এখন দেয়া শুরু হয়েছে। সোনারচরকে এরই মধ্যে ‘অভয়ারণ্য’ ঘোষণা করা হয়েছে। নানা প্রজাতির জীবজন্তুর আবাসস্থল হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সোনারচরের পাঁচ হাজার একর জমি পর্যটন মন্ত্রণালয়ের হাতে ন্যস্ত করা হচ্ছে। যেখানে গড়ে উঠবে পরিকল্পিত আবাসনসহ পর্যটনবান্ধব নানা স্থাপনা। সোনারচরে শীঘ্রই শুরু হচ্ছে ইকোপার্ক নির্মাণ কাজ। ইকোপার্কের আওতায় তৈরি হবে একাধিক ওয়াচ টাওয়ার। যেখানে দাঁড়িয়ে পর্যটকরা গভীর বন এবং বনাঞ্চলের জীবজন্তুর দৃশ্য উপভোগ করতে পারবে। সোনারচরের অভ্যন্তরের খালগুলোকে লেকে রূপ দেয়া হবে। লেকগুলোতে থাকবে ভেসে বেড়ানোর ব্যবস্থা। একাধিক রেস্টহাউজ নির্মিত হবে। যেখানে পর্যটকরা পাবে আবাসনের ব্যবস্থা। গড়ে তোলা হবে মিনিপার্ক ও পিকনিক স্পট। নির্ধারিত অর্থের বিনিময়ে পর্যটকরা এগুলো ব্যবহারের সুযোগ পাবে। হেলিকপ্টার ওঠানামার জন্য তৈরি হবে হেলিপ্যাড। তৈরি হবে ফুল ও ফলের বাগান। মোটকথা পর্যটকদের সামনে সোনারচরকে আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে নেয়া হয়েছে নানা পরিকল্পনা এবং উদ্যোগ। এগুলো বাস্তবায়ন হলে সোনারচর হবে দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।

-শংকর লাল দাশ, গলাচিপা

No comments

Powered by Blogger.