মালি-সংকট- ফরাসি হস্তক্ষেপ ঠেকাতে পারবে জঙ্গিদের?

মালিতে জঙ্গি ইসলামপন্থীদের অগ্রাভিযান ঠেকাতে শেষ পর্যন্ত পদাতিক সেনা পাঠাল ফ্রান্স। দেশটির বিশেষ বাহিনীর সদস্যরা এখন জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়ছে। গত সোমবার বিমান হামলা শুরু করার পরই ফ্রান্স তার সাবেক উপনিবেশে এ স্থলসেনা পাঠাল।
সোমবার জঙ্গিরা দিয়াবালি শহর দখল করার পর বিমান হামলা শুরু করা হয়। শহরটির অবস্থান রাজধানী বামাকোর ৩৫০ কিলোমিটার উত্তরে।
জঙ্গিরা গত বছর পশ্চিম আফ্রিকার দেশটির উত্তরের অর্ধেক অঞ্চল দখল করে নেয়। সম্প্রতি তারা আরও দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। মালির সেনাবাহিনী যে তাদের ঠেকাতে সক্ষম নয়, এটা স্পষ্ট। তাই সাবেক ঔপনিবেশিক শাসক ফ্রান্সের সহায়তা চেয়েছিল মালি সরকার।
তুয়ারেগ আদিবাসীদের বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে গত বছরের শুরুর দিকে সামরিক অভ্যুত্থান হয় মালিতে। দেশটির অবস্থা সেই থেকে টালমাটাল। একসময় পশ্চিম আফ্রিকায় উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের মডেল হিসেবে বিবেচিত মালি পড়ে সংকটের আবর্তে। বলা হয়, দেশটি কার্যত অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। ১৯৬০ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর এমন ঘোর সমস্যার মুখে আর কখনোই পড়েনি তারা।
মালিতে জঙ্গিদের শক্তি বৃদ্ধিকে নিজের জন্যও হুমকি বলে মনে করে প্যারিস। তাদের ভয়ের কারণ দুটি। প্রথমত, ইতিহাস। মালিসহ আফ্রিকার সাবেক উপনিবেশগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায় ফ্রান্স। দ্বিতীয়ত, মালিতে জঙ্গিদের উত্থান প্রথমে তাদেরই বিপদে ফেলবে। কারণ, ওই জঙ্গিদের অনেক আত্মীয়স্বজন ফ্রান্সে বাস করে। দেশটি থেকে অনেক মালি বংশোদ্ভূত জঙ্গিদের পক্ষে লড়তে সে দেশে ঢুকছে।
মালির জঙ্গিরা মূলত জোট হয়ে লড়ছে। এ জোটের প্রধান তিনটি গোষ্ঠীর একটি হলো আল-কায়েদা ইন ইসলামিক মাগরেব (একিউআইএম)।
মালিতে জঙ্গি উত্থানে আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) ও পশ্চিমা দেশগুলোও উদ্বিগ্ন।
১০ জানুয়ারি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সেখানে আন্তর্জাতিক বাহিনী ‘দ্রুত মোতায়েনের’ পক্ষে একটি প্রস্তাব পাস করে। পরদিনই ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লরাঁ ফ্যাবিয়াস নিশ্চিত করেন, মালিতে বিমান হামলা শুরু করেছে তাঁর দেশ। কূটনীতিক সূত্রে জানা গেছে, সেনেগাল ও নাইজেরিয়ার অল্পসংখ্যক সেনাও এই অভিযানে অংশ নিচ্ছে।
মালিতে অভিযানের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ বলেন, মালিতে ফ্রান্সের ছয় হাজার নাগরিক আছেন। তাঁদের রক্ষায় এই অভিযান চালানো হচ্ছে। জঙ্গিদের হাতে ফ্রান্সের সাতজন নাগরিক জিম্মি থাকার বিষয়টিও মালিতে অভিযানের পক্ষে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরেন ওলাঁদ।
মালিতে সংঘাত শুরু হয় মূলত ২০১২ সালের গোড়ার দিকে। আদিবাসী তুয়ারেগ বিদ্রোহী ও জঙ্গি ইসলামপন্থীরা জোট বেঁধে বিদ্রোহ করে। তাঁদের অভিযোগ, তুয়ারেগদের প্রান্তিক করে রাখা হচ্ছে। গত বছরের মার্চে মালির সেনাবাহিনী তুয়ারেগ-জঙ্গিবিরোধী ব্যর্থ অভিযান চালায়। তুয়ারেগ-জঙ্গি জোট কয়েক দিনের মধ্যে দেশটির প্রাচীন শহর টিমবাকটুসহ পুরো উত্তরাঞ্চল দখল করে নেয়। কিন্তু ওই বছরের জুন-জুলাইয়ে জঙ্গিরা তুয়ারেগদের জোট থেকে বের করে দিয়ে উত্তরাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে নেয়। একপর্যায়ে তারা ওই অঞ্চলে শরিয়া আইন চালু করে। এরপর থেকে জঙ্গিরা মালির উত্তরাঞ্চল শাসন করে আসছে। অনৈসলামিক আখ্যা দিয়ে তারা টিমবাকটুসহ বিভিন্ন স্থানের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে বিশ্বসংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে জাতিসংঘের সংরক্ষিত স্থাপনাও।
পশ্চিমা নাগরিকদের জিম্মি করে ও মাদক পাচার করে কোটি কোটি ডলার কামিয়েছে এই জঙ্গিরা। সেই অর্থ দিয়ে লিবিয়ার সাবেক শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির কাছ থেকে অস্ত্র কিনেছে। জঙ্গিরা এ কাজে গাদ্দাফির পক্ষে লড়াই করা তুয়ারেগদের ব্যবহার করেছে। মালির জঙ্গিদের হাতে থাকা অস্ত্র অনেক ক্ষেত্রে দেশের সেনাবাহিনীর অস্ত্রের চেয়ে উন্নত। সেনাবাহিনীর অস্ত্র-সরঞ্জাম ও রণ-পরিকল্পনার দুর্বলতা আর বেতন-ভাতার সমস্যার সুযোগও নিয়েছে জঙ্গিরা।
জাতিসংঘ ও ফ্রান্সের একটি পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল, পশ্চিম আফ্রিকার জোটভুক্ত (ইসিওডব্লিউএএস) দেশের তিন হাজার সেনা মালিতে জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালাবে। ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র মালির সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ সহায়তা দেবে। পরে বাস্তবতা বিবেচনায় গত ২০ ডিসেম্বর মালিতে সামরিক অভিযানের পক্ষে প্রাথমিক প্রস্তাব জাতিসংঘে অনুমোদিত হয়। সেই প্রস্তাবে কিছুটা ‘ঘাটতি থাকায়’ ১০ জানুয়ারি জরুরি অধিবেশনে সামরিক অভিযানের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। বুরকিনা ফাসোর মধ্যস্থতায় জঙ্গিদের সঙ্গে শান্তি আলোচনা করা হয়েছিল। কিন্তু গত ডিসেম্বরে সর্বশেষ দফার আলোচনা কোনো অগ্রগতি ছাড়াই শেষ হয়।
 মাহফুজার রহমান
সূত্র: টাইম সাময়িকী

No comments

Powered by Blogger.