কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সয়াবিনের মূল্যবৃদ্ধি

ভোজ্য তেল ও চিনির সরবরাহ ঠিক রাখতে এবং দাম স্থিতিশীল রাখতে ঘটা করে চালু করা হয়েছিল পরিবেশক প্রথা। দেড় বছরের মধ্যে সেই প্রথা অনেকটাই অকার্যকর হয়ে গেছে। অন্যদিকে চলছে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো। পরিবেশক প্রথা কার্যকর করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো উদ্যোগ নেই।
আবার তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে খুচরা বাজারেও নেই কোনো তদারকি। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমলেও ভোক্তারা সুফল পাচ্ছে না।
পাইকারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ভোজ্য তেল পরিশোধন কল মালিকরা সয়াবিন তেলের আমদানি কমিয়ে দিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছেন। অন্যদিকে কল মালিকরা দাবি করছেন, তাঁদের ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। অব্যাহত লোকসানের ফলে অনেকেই এখন তেল কল বন্ধ করে দিচ্ছেন।
খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১৪-১৬ টাকা বাড়ানো হয়েছে মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে। বাজারে এক লিটার খোলা সয়াবিন তেল কিনতে ক্রেতাকে ১২৮-১৩০ টাকা দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে এক লিটারের বোতলজাত তেলের দাম রাখা হচ্ছে ১৩৩-১৩৪ টাকা।
ভোজ্য তেলের দাম কত হতে পারে তা বিশ্লেষণ করে প্রতি মাসেই বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন গঠিত মনিটরিং সেল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে প্রতিবেদন দেয়।
সেই প্রতিবেদন প্রতি মাসেই চলে যায় হিমাগারে।
কয়েক দিনের সরবরাহ সংকটের সুযোগ নিয়ে বেশ কিছু ব্যবসায়ী বাজারে সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। পাইকারি বাজারে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১২-১৪ টাকা বেড়ে গেছে। অন্যদিকে এ সুযোগে খুচরা ব্যবসায়ীরাও বেশি মুনাফা নিচ্ছেন।
বাজারে দাম বাড়লেও তেল কল মালিকরা বলছেন, তাঁদের ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। ট্যারিফ কমিশনের হিসাব করা কাঙ্ক্ষিত দর নিয়েও তাঁদের আপত্তি রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে তা সংগতিপূর্ণ নয় বলে তাঁদের দাবি।
আমদানি কম করার কথা স্বীকার করেছেন ব্যবসায়ীরাও। নূরজাহান গ্রুপের পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, ২০১২ সালে ভোজ্য তেল আমদানি হয়েছে ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার। আগের বছর ১৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি তেল আমদানি হয়েছিল। মিজানুর রহমান বলেন, '২০০৯-১০ সালে ভোজ্য তেল আমদানি বেশি হয়েছিল। এখন আমরা আমদানি কমাতে বাধ্য হয়েছি। এর কারণ ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ঋণপত্র খুলতে ব্যাংকের কড়াকড়ি।'
২০১২ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সাড়ে আট লাখ টন ভোজ্য তেল আমদানি হয়। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ সয়াবিন এবং ৭০ শতাংশ পাম অয়েল। পাম অয়েলের দাম কম থাকায় অন্য মৌসুমে তা সয়াবিনের সঙ্গে মেশানো হয় বলে অভিযোগ আছে। তবে শীতে তা সম্ভব হয় না পাম অয়েল জমে যাওয়ার কারণে। দাম বাড়ার পেছনে এটিও একটি কারণ বলে দাবি করা হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির বুধবারের বৈঠকে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কমিটির সদস্য তহুরা আলী বলেন, সব কিছুর দামই যে খুব বেড়ে গেছে তা নয়। চালসহ অনেক পণ্যের দামই কম আছে। তিনি জানান, সয়াবিন তেলের আমদানি কমিয়ে সরবরাহ ঘাটতি তৈরির কোনো অভিযোগ তাঁরা পাননি। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (টিসিবি) সক্রিয় করার কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। তিনি বলেন, টিসিবি শিগগরিই কার্যক্রম শুরু করবে। তখন ভোক্তারা সুফল পাবে।
২০১১ সালের ১৬ মার্চ 'কন্ট্রোল অব এসেনশিয়াল কমোডিটিস অ্যাক্ট ১৯৫৬'-এর আওতায় 'অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ' জারি করে সরকার। ওই আদেশের মাধ্যমে ভোজ্য তেল ও চিনির পুরনো ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) প্রথা বাতিল করে পরিবেশক প্রথা চালু করা হয়। তখন কম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ডিও ব্যবসায়ীরা শেয়ারের মতো ডিও হাতবদল করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। তাদের উৎখাত করার জন্যই পরিবেশক প্রথা প্রয়োজন। এখন আবার সেই কম্পানিগুলোই পরিবেশকদের পণ্য না দিয়ে ডিও ব্যবসায়ীদের পণ্য সরবরাহ করছে।
২০১১ সালের ২১ জুন এক বছরের আলোচনা শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিবেশক প্রথা চালু করা হয়। তখন বলা হয়, কম্পানিগুলো তাদের নিয়োগ করা পরিবেশকদের পণ্য সরবরাহ করবে। পরিবেশকরা সেই পণ্য খুচরা ব্যবসায়ীদের সরবরাহ করবেন। সারা দেশে একটি নির্দিষ্ট পণ্যের একই দাম হবে। কম্পানিগুলো দাম বাড়াতে চাইলে ১৫ দিন আগে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন গঠিত দ্রব্যমূল্য মনিটরিং সেলকে জানাবে। কিন্তু ওই সব নিয়মের কোনো কিছুই এখন মানা হচ্ছে না।
মনিটরিং সেলের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে পরিবেশকদের ১২ লাখ টন ভোজ্য তেল সরবরাহ করার কথা। কিন্তু ওই সময়ে সরবরাহ হয়েছে মাত্র তিন লাখ ৭০ হাজার টন তেল, যা মোট সরবরাহের ৩১ শতাংশ। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী পরিবেশকদেরই ভোজ্য তেল সরবরাহ করার কথা।
মনিটরিং সেলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত নভেম্বর পর্যন্ত আগের তিন মাসে পরিবেশকদের মধ্যে সিটি গ্রুপ ৮৯ হাজার ৮৫৫ টন, টিকে গ্রুপ ৪২ হাজার ৮৪০ টন, এস আলম গ্রুপ দুই হাজার ৯৫১ টন, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড ১৬ হাজার ২৯ টন ভোজ্য তেল সরবরাহ করেছে। সাতটি প্রতিষ্ঠান পরিবেশকদের কোনো তেল সরবরাহ করেনি। এগুলো হলো মেঘনা গ্রুপ, এসএ অয়েল, ইলিয়াস ব্রাদার্স, মোস্তফা গ্রুপ, রুবাইয়া অয়েল ও সেভেন সার্কেল এডিবল অয়েল লিমিটেড; যদিও এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কয়েকটির তেল আমদানি বন্ধ আছে।
রুবাইয়া ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, 'তেলের ব্যবসা অনেক দিন ধরে ভালো যাচ্ছে না। এ কারণে প্রায় ছয় মাস ধরে আমাদের আমদানি বন্ধ আছে।'
এ বিষয়ে ভোজ্য তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সমিতির সভাপতি সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ভোজ্য তেলে এত ভালো ব্যবসা হলে বেশ কয়েকটি মিল বন্ধ হয়ে যেত না। খুচরা দোকানদারদের ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তারা লিটারে ১০ টাকা লাভ করতে চাইলে আমরা কী করতে পারি?'
সিটি গ্রুপ সবচেয়ে বেশিসংখ্যক পরিবেশক নিয়োগ দিয়েছিল। তবে ফজলুর রহমান বলেন, 'ভালো ব্যবসা হলে পরিবেশকরা পণ্য নিতে আসত। তারা না এলে সেই পণ্য ধরে রাখা সম্ভব নয়। কারণ দৈনিক ১৬ শতাংশ হারে ব্যাংক ঋণের সুদ দিতে হয়। সেই সুদ কে দেবে? মিলগুলো এখন আর ডিও বিক্রি করে না। বিক্রি করে এসও (সাপ্লাই অর্ডার)।'
ভোজ্য তেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ইলিয়াস ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোয়েব রিয়াদ বলেন, 'তিন বছর ধরে তেলের বাজার ভালো নয়। ব্যাংকে অনেক ঋণ জমে গেছে। এ কারণে আমরা ব্যবসা গুটিয়ে নিতে চাচ্ছি।'

No comments

Powered by Blogger.