সিরিয়া নিয়ে জট ছাড়ছে না

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের বিজয় অভিযান ধীর হলেও অব্যাহত রয়েছে। গত শুক্রবারও একটি গুরুত্বপূর্ণ হেলিকপ্টার ঘাঁটি দখলে নিয়েছে তারা। বিদ্রোহীদের এগিয়ে চলা অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে, এখনো অনড় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ।
অর্থাৎ বর্তমান অবস্থা বজায় থাকলে সামনে বড় মাত্রায় রক্তক্ষয়ের সমূহ সম্ভাবনা। কিন্তু সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা চলছে খুবই ঢিমেতালে। কিছুতেই জট ছাড়ছে না। দুই পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান পথ খুঁজে পেতে এখনো গলদঘর্ম হচ্ছেন আন্তর্জাতিক কূটনীতিকেরা।
সিরিয়া সংকটের অবসান কতটা কঠিন হবে, তা কিছুটা আঁচ করা গেছে গত শুক্রবার। সেদিন রাশিয়ার উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী মিখাইল বোগদানোভ ও যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম বার্নস জেনেভায় জাতিসংঘের সিরিয়াবিষয়ক দূত লাখদার ব্রাহিমির সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল, সিরিয়াসংকট নিরসনে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নের চেষ্টা করা। আলোচনা শেষে সাংবাদিকেরা লাখদার ব্রাহিমির কাছে জানতে চান, দিনব্যাপী বৈঠকের মেজাজটা কেমন ছিল। ‘আশাবাদ ও নৈরাশ্যবাদ ব্যাখা করা কঠিন,’ এই ছিল ব্রাহিমির গা-বাঁচানো জবাব। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, বর্তমান ভয়ংকর পরিস্থিতিতে সিরীয়দের সহায়তা শুরুর পথ খুঁজছেন তাঁরা।
আলোচনার গতিপ্রকৃতি দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না যে এটা মোটেও সহজ হবে না। গত মাসে প্রেসিডেন্ট বাশারের সঙ্গে মস্কোর দীর্ঘদিনের সহযোগিতার সম্পর্ক ছিন্ন করার অনানুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন বোগদানভ। ওই সময় তিনি খোলাখুলি অনেক কথাই বলেন। বোগদানভ বলেছিলেন, কিছুটা সময় লাগলেও বিদ্রোহীরা নিশ্চিত জয়ের পথে বলেই মনে হচ্ছে। পশ্চিমা নেতারাও এটা অবশ্যম্ভাবী বলে মনে করে আসছেন। উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী বোগদানোভের ওই মন্তব্যের পর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, সিরিয়ার বর্তমান সরকারের প্রতি কোনো মোহ নেই রাশিয়ার। মনে করা হচ্ছে, এই বক্তব্যের মাধ্যমে পুতিন এ ইঙ্গিতই দিলেন যে বাশারের দিন শেষ বলেই তাঁদের ধারণা। রুশ নেতাদের এসব বক্তব্যে বোঝা যায়, দেশটি তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ আরব মিত্রকে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়া থেকে এখন দূরে আছে। তবে রুশ কর্মকর্তারা একই সঙ্গে জোর দিয়ে বলছেন, বাশারের অপসারণে তাঁরা কোনো ধরনের চাপ দেবেন না।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গত মাসে বাশারবিরোধীদের জোট সিরিয়ান ন্যাশনাল কোয়ালিশনকে সিরীয়দের প্রকৃত প্রতিনিধি হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কূটনীতিকেরা এরই মধ্যে বলে দিয়েছেন, ভবিষ্যতে সিরিয়া সরকারে বাশারের কোনো স্থান নেই। কয়েক মাস ধরে মস্কো ও দামেস্কে দৌড়াদৌড়ির পর লাখদার ব্রাহিমিও শেষ পর্যন্ত একই কথা বলছেন। তিনি সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, গত বছর সম্পাদিত আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী সিরিয়ায় কোনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলে বাশার ‘নিশ্চিতভাবেই’ সেই সরকারে থাকবেন না। ব্রাহিমি বলেন, তাঁর বিশ্বাস সিরিয়ার মানুষ মনে করছে যে ৪০ বছর ধরে দেশ শাসন করা একটি পরিবারের জন্য অনেক বেশি সময়। তিনি বলেন, ‘পরিবর্তন হতে হবে সত্যিকারের।’
মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে অগুনতি বৈঠক এবং সম্মেলনের পরও সিরিয়ার ব্যাপারে পরিষ্কার আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে ব্রাহিমির সঙ্গে ‘আন্তরিক’ সম্পর্কের ইতি ঘটিয়েছেন বাশার। তাঁর অভিযোগ, আলজেরিয়ার সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদ্রোহীদের প্রতি ‘পক্ষপাতদুষ্ট’। বাশারের এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে শান্তিচুক্তি করার ক্ষেত্রে লাখদার ব্রাহিমি কতটা ভূমিকা রাখতে পারবেন, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। ব্রুকিংস দোহা সেন্টারের পরিচালক ও সিরিয়ার বিশেষজ্ঞ সালমান শাইখ বলেছেন, ‘ব্রাহিমি যদি আগামী কয়েক দিনের মধ্যে সমর্থন না পান, আমার মনে হয়, তাঁর মিশন শেষ হয়ে যাবে।’
কূটনৈতিক এই অচলাবস্থার মধ্যে ভোগান্তি দীর্ঘায়িত হচ্ছে সিরিয়ার সাধারণ মানুষের। বিশেষ করে দেশ ছেড়ে পালানো শরণার্থীদের অবস্থা শোচনীয়। আন্তর্জাতিক সাহায্যের অপ্রতুলতার মধ্যে দেশটির লাখো মানুষ তীব্র শীতে খুবই কষ্টে আছেন। জাতিসংঘের কয়েকটি সংস্থা সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, ক্রমবর্ধমান খাদ্য, জ্বালানি ও বিদ্যুৎসংকটের কারণে লাখো সিরীয় এখন খুবই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে।
খুব অল্পসংখ্যক বিদেশি ত্রাণকর্মীই সিরিয়ার বিদ্রোহী অধ্যুষিত এলাকায় যাওয়ার সাহস দেখাচ্ছেন। বিদ্রোহী অধ্যুষিত এলাকায় সরকারি বাহিনী প্রতিদিনই বোমা হামলা চালায়। এ কারণেই বিদেশি ত্রাণকর্মীরা সেখানে যেতে চান না। এতে সাধারণ সিরীয়দের দুর্দশা আরও বেড়ে গেছে।
যে অল্প কয়েকটি ত্রাণ সংস্থা বিদ্রোহী অধ্যুষিত এলাকায় ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছে তার একটি হচ্ছে ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস। সম্প্রতি সংস্থাটি বলেছে, বিদ্রোহী অধ্যুষিত এলাকায় যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসার সুযোগ সীমিত। সংস্থার জরুরি কার্যক্রম ব্যবস্থাপক মেগো তারজিয়ান বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষই নার্সের কাজ করছেন, কখনো কখনো তাঁদের শল্যবিদের ভূমিকা পর্যন্ত নিতে হচ্ছে। কারণ সেখানে এই কাজের কোনো লোকই নেই।’
 দাউদ ইসলাম

No comments

Powered by Blogger.