কুয়াকাটায় সৌন্দর্য উপভোগের হাতছানি

কুয়াকাটা। দেশজুড়ে রয়েছে এই নামটির পরিচিতি। খ্যাতি রয়েছে বিদেশেও। দর্শনীয় স্থান। এ সৈকতের বেলাভূমে একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের মনোরম, বর্ণিল ও দুর্লভ দৃশ্য অবলোকন করা যায়।
এদৃশ্য বিমোহিত করে আগত পর্যটক ও দর্শনার্থীকে। অপরূপ এই দৃশ্য দেখতে পারায় কুয়াকাটাকে বলা হয় ‘সাগরকন্যা কুয়াকাটা।’
জেলা শহর পটুয়াখালীর সাগরতীরবর্তী কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নের শেষপ্রান্তে সাগরঘেঁষা কুয়াকাটা নামের গ্রামটি এখন সর্বত্র সমধিক পরিচিত। সর্বশেষ কুয়াকাটাকে পৌরসভায় উন্নীত করা হয়েছে। প্রায় ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং দুই কিলোমিটার প্রস্থ কুয়াকাটা সৈকতটি পরিচ্ছন্নতার কারণে আগতদের কাছে খুবই সমাদৃত। এখানে নিরাপত্তাহীনতার কোন কারণ নেই। ফলে দিন-রাত সমানভাবে, সমানতালে, নির্বিঘেœ আমুদে সময় কাটান এখানে আসা প্রকৃতি প্রেমিকেরা। দারুণ এক স্বস্তিতে প্রকৃতির অপার এই দৃশ্য উপভোগ করেন পর্যটকরা। প্রত্যুষে সাগর¯œাত সূর্যের উদয় দেখতে পুবের আকাশপানে চেয়ে থাকার সেই যে অপেক্ষা। বেলা দুপুর গড়াতেই সাগরের নীলজলে উপভোগ্য ¯œান। আর শেষ বিকেলে খালি পায়ে সৈকতের বেলাভূমে দাঁড়ানো, লোনা ও শীতল জলের স্পর্শে পা ভেজানো অনুভূতি শরীরের মধ্যে কী যে শিহরণ জাগায় তা বোঝানো যাবে না। মনের মধ্যে ভেসে ওঠে হারানো সব স্মৃতি। যদি থাকেন একাকী। সীমাহীন সাগরে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে ইচ্ছে করে অনেক কিছুই। কিন্তু নির্বাক হয়ে যান সবাই। শুধু চেয়ে থাকেন যতদূর দৃষ্টি যায়। সবশেষ পশ্চিমের আকাশে সূর্যের সাগর অতলে হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্য...। এসব চোখে না দেখলে বোঝানো যায় না।
কুয়াকাটা সৈকতের কোলঘেঁষে রয়েছে নারিকেল, ঝাউ ও কড়ই বাগান। পুবের শেষদিকে গঙ্গামতির বিরাট সংরক্ষিত বনাঞ্চল। যার মাঝখানের লেকটি বনাঞ্চলকে করেছে বিভক্ত। পশ্চিমের শেষে মোহনায় রয়েছে আরেক অপরূপ লেম্বুরচর বনাঞ্চল। এখানে দাঁড়িয়ে আন্ধারমানিক নদী মোহনার উল্টোদিকে দূর থেকে দেখা যায় দশ সহস্রাধিক একরজুড়ে মনোরম বিস্তৃত ফাতরার বনাঞ্চল।
সৈকতের কিনারে রয়েছে ছোট্ট একটি শালবাগান। বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের উত্তরদিকে রয়েছে কুয়াকাটা সৃষ্টির ইতিহাস, সেই কুয়াটি। এখানকার আদি বাসিন্দা রাখাইন সম্প্রদায় মিঠাপানি সংগ্রহের জন্য খনন করেছিল কুয়াটি। প্রায় সোয়া দু’শ’ বছর আগের কথা। তখন আরাকান থেকে বিতাড়িত রাখাইনরা বনজঙ্গল কেটে আবাদ ও বাসের উপযোগী করে এই শ্বাপদ সঙ্কুলের জনপদ। সেই রাখাইন উপজাতির রয়েছে ভিন্ন জীবনযাত্রা। টংঘরের রাখাইন পল্লী। রয়েছে টং এর নিচে কাপড় বুননের তাঁত। স্বচক্ষে দেখার সুযোগ রয়েছে রাখাইনদের এসব ভিন্নমাত্রার জীবন-বৈচিত্র্য। বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী এই সম্প্রদায়ের রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মীয় মন্দির। শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধবিহার নাম এটির। বর্তমানে কুয়াকাটায় আগতরা মন্দিরটি দর্শনে ভুল করেন না। এটিকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে গৌতম বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন অষ্টধাতুর বিশালকায় বৌদ্ধমূর্তি। রাখাইনদের দাবি এর ওজন ৮৭ মণ। এছাড়াও কুয়াকাটার অদূরে রয়েছে মিশ্রিপাড়া রাখাইন পল্লীতে আরও একটি দর্শনীয় বৌদ্ধবিহার। যার মধ্যে বিশালকায় প্রায় ৭০ ফুট উঁচু গৌতমবুদ্ধের মূর্তি রয়েছে। স্থানীয় রাখাইনদের দাবি এই মূর্তিটি এশিয়ার মধ্যে সর্ববৃহৎ। প্রতিদিন সেখানে ভিড় জমে অসংখ্য পর্যটক। মিশ্রিপাড়ার কয়েক কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণ দিকেই রয়েছে পর্যটন পল্লী গঙ্গামতি সৈকত। যেখানে সাগরের বেলাভূমে লাল কাকড়াদের বিচরণ দেখা যায়। বিশাল এই সৈকত পর্যন্ত এখন যোগাযোগের জন্য দুর্ভোগ পোহাতে হয় না। পাকা মসৃণ সড়ক রয়েছে গঙ্গামতি সৈকত পর্যন্ত।
কুয়াকাটায় অবকাশ যাপনের জন্য আগতদের এখন আর ভাবতে হয় না। পর্যটন কর্পোরেশনের একাধিক মোটেল রয়েছে। বেসরকারিভাবে নির্মিত হয়েছে অর্ধশতাধিক উন্নত আবাসিক হোটেল। রয়েছে উন্নত মানের খাবার হোটেল। টাটকা ইলিশ আর রূপচাঁদার ফ্রাই খেতে ভুল করেন না আগতরা।
ঢাকা থেকে বাসযোগে কুয়াকাটায় আসার সহজ সুযোগ রয়েছে। কুয়াকাটায় যোগাযোগের জন্য জেলা সদর পটুয়াখালী থেকে উন্নত মানের সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। কলাপাড়া থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার সড়কের তিনটি নদীতে এখন চলছে ব্রিজ নির্মাণের কাজ। বিগত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রিজ তিনটির নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ইতোমধ্যে শিববাড়িয়া নদীর ওপরে শেখ রাসেল সেতুর নির্মাণ কাজ প্রায় ৭৫ ভাগ শেষ হয়েছে। কুয়াকাটার উন্নয়নে পর্যটন এলাকা চিহ্নিতের জন্য ল্যান্ড জোনিং-এর কাজ চলছে। সৈকতঘেরা বেড়িবাঁধের উন্নয়নে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে স্লোপ সংরক্ষণ প্রকল্পের মাধ্যমে খাজুরা থেকে ধোলাইর মার্কেট পর্যন্ত বাঁধের কাজ শুরু করা হয়েছে। সৌন্দর্যময় সমুদ্র সৈকত আধুনিক পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটায় এখন চলছে এক চিলতে জমি কেনার প্রতিযোগিতা। ইতোমধ্যে অন্তত অর্ধশত আবাসন কোম্পানি ঘাঁটি গেড়েছে। কিনছে হাজার হাজার একর জমি। তবে প্রতারিতের হাত থেকে রক্ষার জন্য জমি কেনাবেচায় জেলা প্রশাসকের অনুমতি নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাই কুয়াকাটায় বেড়াতে আসুন। আপনিও হোন কুয়াকাটার বাসিন্দা। স্বপ্নের পূরণ করুন সার্থকতার সঙ্গে।

Ñমেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া

No comments

Powered by Blogger.