সফল এক রাষ্ট্রনায়কের জন্মদিনে by লে. জে. মাহবুবুর রহমান (অব.)

স্বাধীনতাযুদ্ধের মহান সৈনিক জিয়াউর রহমান। অসামান্য সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি। আমরা যদি একাত্তরের ২৫ মার্চের আগের ও পরের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করি, তাহলে তার প্রমাণ পেয়ে যাব। ২৫ মার্চে গণহত্যার সময় অস্বাভাবিক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয় দেশে।
অথচ সেই সময় তিনি সেনাবাহিনীর সাধারণ শৃঙ্খলায় আবদ্ধ ছিলেন। তার পরও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। এটা সুশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্য হওয়ার পর যে কারো জন্য ছিল অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু সেই অসম্ভব ব্যাপারটিই তিনি করলেন। নিজেই সিদ্ধান্ত নিলেন, আর পাকিস্তানি বাহিনীতে নয়- দেশের জন্য কাজ করতে হবে। স্বাধীনতার জন্য কাজ করতে হবে। নিজের সিদ্ধান্তের কথা বললেন অধীনস্থ সৈনিকদের। আমরা দেখতে পেলাম, দেশের একটি অনন্য ইতিহাস তৈরি হলো তারপর। তিনি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে গিয়ে ঘোষণা দিলেন মহান স্বাধীনতার। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা হয়ে দাঁড়াল একটি বাণী- 'আমি মেজর জিয়া বলছি।' যোদ্ধারা ঐক্যবদ্ধ হলেন, গ্রামগঞ্জের মানুষ উদ্বুদ্ধ হলেন। তাঁর এই সিদ্ধান্ত ও ঝুঁকি এটা প্রমাণ করে যে তিনি ছিলেন মহান এক স্বপ্নদ্রষ্টা। একজন সৈনিক তাঁর দেশপ্রেম, সময়োচিত সিদ্ধান্ত এবং সেই অনুযায়ী কর্ম পরিচালনার মাধ্যমে হয়ে গেলেন মহান এক নেতা।
৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলো। তিনি নতুন দেশের সেনাবাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেলেন। কিন্তু সিনিয়র হওয়ার পরও তিনি সেনাপ্রধান হতে পারলেন না। তাঁর মনে ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনা। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য ছিল তাঁর বিশাল অর্জন। সেই অর্জনকে তিনি অনেক বড় মনে করলেন। যে কারণে তাঁর পক্ষে সবই মেনে নেওয়া সম্ভব হলো। এখানেও একজন দেশপ্রেমিক সৈনিকের প্রমাণই আমরা পাই।
তারপর দেশে বিপ্লব হলো। সেই বিপ্লবে জনগণও সম্পৃক্ত হয়ে গেল। একজন সেনানায়ক হিসেবে সৈনিকদের সর্বাত্মক শ্রদ্ধা তিনি পেলেন। সৈনিকরাই তাঁকে বের করে আনেন। কিন্তু তিনি দেখলেন, সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। সেই কাজেও সফল হলেন তিনি। সৈনিকরা তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন। সেখানে তিনি অধিনায়কসুলভ আচরণ করলেন এবং সফলও হলেন। যদি সেদিন সৈনিকরা ঐক্যবদ্ধ না হতেন এবং তাঁকে অধিনায়ক হিসেবে না মান্য করতেন, তাহলে দেশের ইতিহাস যে কী হতো তা ভাবা যায় না। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্ব ও প্রজ্ঞা সেই সাফল্য এনে দিতে সক্ষম হয়েছে। ওই পরিস্থিতি যাঁরা দেখেননি তাঁদের পক্ষে বিষয়টি অনুমান করা সত্যি কঠিন। এটা ছিল অসম্ভব ব্যাপার। মুক্তিযুদ্ধের মতো আরেকটি অসম্ভব ব্যাপারও সাধন করলেন সেনানায়ক জিয়াউর রহমান।
অসাধ্য সাধন করার যে ক্ষমতা, সেই ক্ষমতার স্বাক্ষর তিনি পরবর্তীকালেও রেখেছেন। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে আমরা তার অসংখ্য প্রমাণ পেয়েছি। দেশের পরিবর্তন আনলেন।
রাজনৈতিক শূন্যতা থেকে দেশকে রক্ষা করলেন তিনি। নির্বাসিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ইতিহাসে স্থান করে নিলেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা যেখানে কল্পনার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেই স্বাধীনতা তিনি নিশ্চিত করলেন। আগে যেখানে মাত্র চারটি পত্রিকা বের করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, বাকশাল সরকার নির্দেশ দিয়ে যেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করেছিল, সেই স্বাধীনতা তিনি সুদৃঢ় করলেন। একদলীয় শাসনব্যবস্থা থেকে দেশকে বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফিরিয়ে আনলেন। দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনার এই সাফল্যই তাঁকে চিরজীবী করে রাখার জন্য যথেষ্ট বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশের অবস্থা যে কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছিল, তা বোধ করি ভুলে যাওয়ার নয়। বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। তিনি সেই বদনাম থেকে দেশকে রক্ষায় সর্বাত্মক চেষ্টায় নিয়োজিত হলেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রনায়ক সেই ভূমিকাতেও সাফল্য আনতে সক্ষম হলেন। রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান খুব বেশি দিন ক্ষমতায় ছিলেন না। কিন্তু তিনি যে মাইলফলক স্থাপন করলেন, তাঁকে আমি অনায়াসে শেরশাহ শূরীর সঙ্গে তুলনা করতে পারি। শেরশাহর স্বল্পকালীন শাসনামলে গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড ও অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নে যে বিশাল অবদান রেখে গেছেন, সেই সাক্ষ্য তিনিও রাখলেন।
জিয়াউর রহমান মনে করতেন, বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে একটি যুদ্ধের মাধ্যমে। যে জাতি যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করে, তাকে মাথা উঁচু করে থাকতে হবে। হিমালয়ের মতো উঁচু শির থাকবে তার। নজরুলের কবিতার সেই চির উন্নত মম শিরকে তিনি লক্ষ্য হিসেবে গণ্য করলেন।
বিশ্বে সেই মাথা উঁচু করে থাকার মাধ্যম হচ্ছে পররাষ্ট্রনীতি। তিনি মনে করলেন, নতজানু পররাষ্ট্রনীতি সেই লক্ষ্য অর্জনের প্রতিবন্ধক। সেই প্রতিবন্ধকতা দূর করলেন তিনি। স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশকে বিশ্বসমাজে সমুন্নত করলেন। সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের নীতিতে তিনি বিশ্বাস করতেন। সেই বিশ্বাসের ফলও দেখলাম আমরা। অর্থনৈতিকভাবে অনেক শক্তিশালী দেশ চীনকে আমরা বন্ধু হিসেবে পেলাম। চীন আমাদের স্বীকৃতি দিল। আজকে চীনের সঙ্গে আমাদের সুদৃঢ় সম্পর্ক, তা কিন্তু জিয়াউর রহমানের সাফল্যের হাত ধরেই এসেছে।
স্বাধীন জাতি হওয়ার পরও আমাদের আইডেনটিটি-ক্রাইসিস ছিল। জিয়াউর রহমান সেই ঐতিহাসিক দায়িত্বটিও পালন করলেন। বাংলাদেশের ঐতিহ্য-কৃষ্টিকে তিনি সুদৃঢ় করলেন। ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সূত্র হিসেবে তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারণা প্রতিষ্ঠিত করলেন। এতে করে মাটি ও মানুষের সম্পৃক্ততা তৈরি হলো।
জিয়াউর রহমান আজকে বেঁচে থাকলে হয়তো দেশের গণতন্ত্র আরো সুসংহত হতো। দেশের উন্নয়ন গতিশীল হতো। আমাদের দুর্ভাগ্য, এই মহান নেতাকে ঘাতকের হাতে প্রাণ হারাতে হলো।
কিন্তু তাঁর যে স্পিরিট, তাঁর যে আদর্শ- সেই আদর্শ এবং প্রেরণা জাতি হিসেবে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট বলে আমি মনে করি। সেই আদর্শ ও স্পিরিটের মাধ্যমে তিনি চিরজীবী হয়ে থাকবেন। আর সেই আদর্শ বাস্তবায়নের কাজটি করে যাচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। এটিও প্রতিষ্ঠা করে গেছেন সেই মহান নেতা জিয়াউর রহমান।
জাতীয়তাবাদের আদর্শ ধারণ করে তাঁর গৃহীত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশ একদিন বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। আজকে এই মহান নেতার জন্মদিনে আমরা সেই প্রত্যাশাই করতে পারি।
লেখক : সাবেক সেনাপ্রধান

No comments

Powered by Blogger.