বিরোধী দলকে মোকাবিলায় নতুন কৌশল- সিটি ও উপজেলা নির্বাচন করতে চায় সরকার

চলতি বছরের মার্চ থেকে অক্টোবরের মধ্যে সাতটি সিটি করপোরেশন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করছে সরকার। ধারাবাহিক এই নির্বাচনের উদ্দেশ্য হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবিতে বিরোধী দলের আন্দোলনের গতি পরিবর্তন ও তাদের চাপে রাখা এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়কের দাবিকে অযৌক্তিক প্রমাণ করা।
সরকারের নীতিনির্ধারণী সূত্রগুলো জানায়, তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে বিরোধী দলের সম্ভাব্য আন্দোলন মোকাবিলায় সরকার তার মেয়াদের বাকি সময়টুকু নির্বাচনমুখী রাখার কৌশল নিয়েছে। একই সঙ্গে ওই নির্বাচনগুলো অবাধ ও নিরপেক্ষ করে রাজনৈতিক সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে নীতিগত অবস্থান সুদৃঢ় করতে চায় সরকার। এর মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠেয় আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরকার দেশবাসীর কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে চায়।
সংবিধান অনুসারে আগামী ২৫ অক্টোবরের পর থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানায়, মার্চ-এপ্রিল থেকে পর্যায়ক্রমে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও নবগঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের চিন্তা আছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে আইনি বাধা থাকলেও তা অপসারণের আইনি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৮ জানুয়ারি আদালত নতুন করে ওই নির্বাচনের ওপর তিন মাসের স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। সরকার এই স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকার মনে করছে, মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করতে কোনো আইনি বাধা থাকবে না।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হবে। আইনি জটিলতা থাকায় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
১৬ জানুয়ারি নবগঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশনের গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই এ সিটি করপোরেশনে প্রশাসক নিয়োগ করা হবে বলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। আইন অনুযায়ী আগামী ছয় মাসের মধ্যে এ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করতে হবে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৫-২০ দিনের মধ্যে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ডভিত্তিক সীমানা নির্ধারণ করে গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে।
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ৪ আগস্ট রাজশাহী, খুলনা, সিলেট ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়। আগামী আগস্টে এই চার সিটি করপোরেশনের মেয়াদ শেষ হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সরকার এই চারটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দীর্ঘ ১৮ বছর পর ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি সারা দেশের ৪৮১টি উপজেলায় নির্বাচন হয়। এসব উপজেলায় আগাম নির্বাচন দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে সরকার। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগস্ট-অক্টোবরের মধ্যে উপজেলা নির্বাচন হতে পারে। নির্বাচন কমিশনও এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
তবে সরকারের এ চিন্তাকে ‘দুরভিসন্ধিমূলক’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তারা এত দিন ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন দিল না। নানা অজুহাতে চারবার তারিখ পরিবর্তন করল। আর সর্বশেষ উপজেলা পরিষদের নির্বাচন হয়েছে গত সংসদ নির্বাচনের পরে। এবার কোন যুক্তিতে উপজেলা নির্বাচন আগে করতে চাচ্ছে? অর্থাৎ সরকার চাচ্ছে, নিজস্ব লোকদের জিতিয়ে এনে তাঁদেরকে সংসদ নির্বাচনে ব্যবহার করতে। এটা জনগণ মেনে নেবে না।’
মহাজোট সরকারের গত চার বছরে জাতীয় সংসদের ১৪টি উপনির্বাচন, চারটি সিটি করপোরেশন, ২৮২টি পৌরসভা, ৪৮১টি উপজেলা পরিষদ এবং চার হাজার ৪২১টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন হয়েছে। এসব নির্বাচনে ১৪ জন সাংসদ, চার মেয়রসহ ৬৩ হাজার ১৯৪ জন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাবি করেছেন, প্রতিটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। এসব নির্বাচন নিয়ে কোথাও কোনো অভিযোগ ওঠেনি। তাঁর প্রশ্ন, মহাজোট সরকারের অধীনে এসব নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হলে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ হবে না কেন?
সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারকের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের বিষয়টি জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করা সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। এ জন্যই সুষ্ঠুভাবে সিটি ও উপজেলা নির্বাচন করে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থার প্রতি জনমত সৃষ্টি করতে চায় সরকার। বিরোধী দল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করলেও আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থায় আর না ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, সরকারের বাকি সময়টা নির্বাচনমুখী রাখতে পারলে বিরোধী দলের আন্দোলন হবে না। আর রাজপথে ব্যর্থ হলে বিদ্যমান ব্যবস্থাতেই বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নেবে। আন্দোলনে সফলতা-ব্যর্থতায় নির্বাচনে জয়-পরাজয় অনেকটা নির্ভর করে। শুধু জামায়াতে ইসলামীর ওপর ভর করে রাজপথে আন্দোলন করার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া বিএনপির জন্য কঠিন হবে।

No comments

Powered by Blogger.