কাশ্মীর নিয়ে আবার তিক্ততা by শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া

কাশ্মীর নিয়ে আবার তিক্ততা সৃষ্টি হলো পাকিস্তান-ভারত সম্পর্কে। কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখার দুই পাশে যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে ফুঁসছেন পারমাণবিক শক্তির অধিকারী দুই দেশের সেনারা।
কয়েক দিনের চরম উত্তপ্ত পরিস্থিতির পর উভয় পক্ষ উত্তেজনা প্রশমনের ব্যাপারে একমত হলেও কাশ্মীর সীমান্তে যে বৈরিতার বিষবাষ্প ছড়িয়েছে, তা ভূস্বর্গের ফুরফুরে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে সময় লাগবে।
সেই ২০০৮ সালের মুম্বাই সন্ত্রাসবাদী হামলার পর থেকে চিরবৈরী দুই দেশের মধ্যে এ মাপের উত্তেজনার কারণ আর ঘটেনি। নয় বছরে ঘটেনি কোনো সীমান্ত সংঘাত।
এবার উভয় পক্ষই অন্যের বিরুদ্ধে উসকানিমূলকভাবে আগে সেনা হত্যার অভিযোগ করেছে। ভারতের দাবি, ৮ জানুয়ারি নিয়ন্ত্রণরেখা পার হয়ে পাকিস্তানি সেনারা তাদের দুই সেনাকে গুলি চালিয়ে হত্যা করেন। এর মধ্যে একজনের শিরশ্ছেদ করা হয়। তাঁর মাথাটিও পাওয়া যায়নি। দুই সেনার অস্ত্রও নিয়ে গেছেন তাঁরা। এ কথার সত্যতা অস্বীকার করে পাকিস্তান পাল্টা অভিযোগ করেছে, ভারতীয় সেনারাই বরং নিয়ন্ত্রণরেখা পার হয়ে তাদের সীমানায় ঢুকে দুই সেনাকে হত্যা করেছে। পাকিস্তানিরা কাউকে আদৌ জবাই করেনি।
ঘটনার প্রতিবাদে ভারত পাল্টা ‘সমুচিত জবাব’ দেবে বলে ক্ষোভ ঝাড়ে। পাকিস্তানও জানিয়ে দেয়, তারাও প্রস্তুত। এ নিয়ে কামান-বন্দুক না গর্জালেও কয়েক দিন ধরে কথার লড়াই চলে। সীমান্তে মোতায়েন দুই দেশের সেনা কমান্ডারদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি আস্থাহীনতা ও তিক্ততার মাত্রা কোথায় পৌঁছেছে, তা বোঝার জন্য দু-একটি উদাহরণই হয়তো যথেষ্ট হবে। উত্তেজনা প্রশমনে গত সোমবার দুই সেনাবাহিনীর ব্রিগেড পর্যায়ে সীমান্ত বৈঠক কোনো সমঝোতা ছাড়াই মাত্র ১৫ মিনিটে শেষ হয়। অন্যদিকে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের মতো মিতবাক নেতা বলে দেন, পাকিস্তানের সঙ্গে আর স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকতে পারে না। পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দুই সেনাকে হত্যার অভিযোগ এনে তিনি বলেন, এটা বর্বরোচিত কাজ।
ভারতের সেনাপ্রধান বিক্রম সিং মন্তব্য করেছেন, ভারত তৎক্ষণাৎ এই উসকানিমূলক আচরণের পাল্টা জবাব দেওয়ার অধিকার রাখে। তিনি তাঁর সেনা অধিনায়কদের নির্দেশ দিয়েছেন, পাকিস্তানি বাহিনী আবার এ ধরনের ‘উসকানিমূলক আচরণ’ করলে তাঁরাও যেন আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
ভারতকে ‘যুদ্ধবাজ’ মনোভাবের দায়ে অভিযুক্ত করে সমালোচনা করেছে পাকিস্তান। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সফরে থাকা পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খার জানান, ভারতের মন্তব্যে পাকিস্তান বিস্মিত। তারা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চায়। তিনি আরও জানান, পাকিস্তান যে এখন বিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়, এই পরিবর্তনের বিষয়টি ভারতকে বুঝতে হবে।
সীমান্তে এই উত্তেজনা কয়েক বছরে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে পাকিস্তান-ভারত সম্পর্কে যেটুকু উন্নতি হয়েছিল, তা নষ্ট করার ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। এ পরিস্থিতিতে উভয় পক্ষের কূটনীতিকেরাই সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, সীমান্তে উত্তেজনা আর বাড়তে দেওয়া ঠিক হবে না। জঙ্গিদের মুম্বাই হামলার পর দুই দেশের সম্পর্ক কার্যত ভেঙে পড়ে। ভারতের দাবি, সেই হামলার জন্য দায়ী পাকিস্তানে ঘাঁটি করা জঙ্গিরাই। অনেক চড়াই-উতরাই ঠেলে কিছুদিন ধরে সম্পর্ক আবার অব্যাহতভাবে উন্নতির দিকে যাচ্ছিল। আলোচনা এগিয়ে চলছিল বাণিজ্য উন্মুক্ত ও ভিসা-প্রক্রিয়া সহজ করা নিয়ে। সীমান্তের এই সর্বশেষ ঘটনা উভয়ের মনোভাব নাটকীয়ভাবে বদলে দিল। ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যে সতর্ক করে দিয়ে জানান, এ ঘটনা আন্তসীমান্ত বাণিজ্য বাড়ানোর প্রচেষ্টার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। পাকিস্তানি প্রবীণদের পাঞ্জাব সীমান্তে পৌঁছে সহজে ভিসা সংগ্রহের মাধ্যমে ভারত সফরের প্রক্রিয়া ‘কারিগরি কারণ’ দেখিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। অথচ ভারত আগে বলেছিল, এটি ইতিমধ্যে চালু হয়ে গেছে। ভারতে অবস্থানরত পাকিস্তানী হকি খেলোয়াড়দেরও বাড়ির পথ ধরতে বলা হয়েছে।
কাশ্মীর সীমান্তে ১৯৯৯ সালে হয় শেষ সংঘাত। এটি সংক্ষিপ্ত হলেও ছিল সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী। সেবার কাশ্মীরের কারগিলে ভারতনিয়ন্ত্রিত এলাকায় ঢুকে পড়েন পাকিস্তানি সেনারা। এই যুদ্ধে পাঁচ শতাধিক ভারতীয় সেনা নিহত হন। এ লড়াইয়ে নিহত পাকিস্তানি সেনার সংখ্যা ছিল চার শতাধিক। কারগিলকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তান পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল সেবার।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সামরিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের অমীমাংসিত সীমান্ত বিরোধগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক একটি কাশ্মীর সীমান্ত। এই সীমান্ত বিশ্বের সবচেয়ে অস্ত্রসজ্জিত সীমানাগুলোরও একটি। নিয়ন্ত্রণরেখার দুই পারের দুই দেশ পাকিস্তান ও ভারত উভয়ই পারমাণবিক শক্তির অধিকারী। কাজেই দুই দেশের সংঘর্ষ ভয়াবহ পরিণাম বয়ে আনতে পারে।
১৯৪৭ সালের আগস্টে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করার পর দুই দেশের মধ্যে এ পর্যন্ত তিনবার যুদ্ধ হয়েছে। এর মধ্যে দুবারই হয়েছিল কাশ্মীর নিয়ে। এই সীমান্তে গুলি বিনিময় অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে হতাহতের ঘটনা বিরল। যে বিষয়টি আশঙ্কার কারণ তা হচ্ছে, পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া, বিশেষ করে ভারতে। ভারতের সেনাধ্যক্ষ ও বিরোধী রাজনীতিকেরা যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তাতে সরকার একটু কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এ জন্য শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষে অন্তত এই মুহূর্তে সমঝোতার কথা বলা কঠিন হয়ে পড়েছে।
পাকিস্তানে এ বছর নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ভারতের নির্বাচনও আর মাত্র এক বছর পর। উভয় দেশের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের জন্যই তাই নির্বাচনী রাজনীতির কথা মাথায় রেখে কাজ করতে হচ্ছে। সশস্ত্র সংঘাতের সম্ভাবনা খুব কম। কথাবার্তা যা-ই হোক, কাজ ঠিক সেই মাত্রায় হবে না।

No comments

Powered by Blogger.