দুই শতাধিক অবৈধ আইনে চলছে দেশ by এম বদি-উজ-জামান

বহুল আলোচিত গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৩ সালে। গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ-১৯৮৩ জারির মধ্য দিয়ে এ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ওই অধ্যাদেশটি অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেছেন ২০১১ সালে।
একইভাবে দেশের রাজস্ব আদায়-সংক্রান্ত আইন আয়কর অধ্যাদেশ-১৯৮৪ এখন অবৈধ ও বাতিল। এসবের পাশাপাশি জমি অধিগ্রহণ-সংক্রান্ত ভূমি সংস্কার আইন, জাতীয় জাদুঘর প্রতিষ্ঠা-সংক্রান্ত আইন জাতীয় জাদুঘর অধ্যাদেশ, পেট্রোবাংলা প্রতিষ্ঠা-সংক্রান্ত আইন বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন অধ্যাদেশ, বিএসটিআই প্রতিষ্ঠা-সংক্রান্ত আইন, বিকেএসপি প্রতিষ্ঠা-সংক্রান্ত আইন, বিআরডিবি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্ট, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কল্যাণে করা কল্যাণ ট্রাস্ট আইন অবৈধ ও বাতিল হয়ে গেছে।
এ কয়টি আইনই শুধু নয়, ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার বছরে করা দুই শতাধিক আইন (অধ্যাদেশ) অবৈধ হয়ে গেছে। সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করায় ওই সময়ে প্রণীত সব আইন অবৈধ ও বাতিল হিসেবে গণ্য হচ্ছে। সপ্তম সংশোধনী বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে ২০১১ সালের ১৫ মে রায় দেওয়ার পর থেকেই ওই সব আইন বাতিল ও অবৈধ বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। তখনকার প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় গত বছরের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি প্রকাশের পর তা পর্যালোচনা করে অবৈধ ও বাতিল হওয়ার তথ্য জানা গেছে।
ওই রায়ের ফলে বাতিল হওয়া আইনের মাধ্যমে যেসব কাজ করা হচ্ছে বা হবে তাও বাতিল ও অবৈধ হিসেবে গণ্য হবে। আর এতে বিপাকে পড়েছে সরকার। তবে সরকার এরশাদের সামরিক শাসনামলে করা ওই সব আইনকে বৈধতা দিতে কাজ শুরু করেছে। ওই সময়ে করা আইনগুলোর মধ্যে কোনটি কার্যকর আছে এবং কোনটির বৈধতা দিতে হবে, তা যাচাই-বাছাই এবং প্রয়োজনীয় করণীয় নির্ধারণের জন্য আইন মন্ত্রণালয় কাজ করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওই সময় করা যেসব প্রতিষ্ঠান বা আইন এখনো কার্যকর, সেগুলোর বৈধতা দিতে হলে নতুন করে অধ্যাদেশ বা আইন করতে হবে। তাঁরা বলছেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর থেকে সংশ্লিষ্ট আইনে যেসব কাজ করা হচ্ছে তা অবৈধ। আর এসব কাজের বৈধতা দিতেও আইন করতে হবে সরকারকে। সরকার এ আইন যত তাড়াতাড়ি তৈরি করবে ততই মঙ্গল। অন্যথায় দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, রায় পাওয়ার পর তা পর্যালোচনার কাজ শুরু হয়েছে। যেসব আইন বাতিল ও অবৈধ ঘোষিত হয়েছে সেসবের বৈধতা দিতে শিগগিরই আইন পাস করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ওই রায়ের পর রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো অসুবিধা সৃষ্টি হয়েছে কি না, জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো অসুবিধা হয়নি। তবে কোনো অসুবিধা হয় কি না, তা খতিয়ে দেখছে আইন মন্ত্রণালয়।
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে দেশে বলবৎ কোনো আইন বাতিল হওয়ার পর সে আইন কার্যকর রাখতে হলে আইনের বৈধতা দিতে জাতীয় সংসদে বিল উত্থাপন করতে হবে। জাতীয় সংসদ পাস করার পর আইন কার্যকর হবে। তবে তিনি সপ্তম সংশোধনী বাতিল-সংক্রান্ত রায় সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক কালের কণ্ঠকে বলেন, ওই সব আইন বা অধ্যাদেশ কার্যকর দেখাতে হলে তার বৈধতা দিয়ে নতুন করে অধ্যাদেশ জারি করতে হবে। যেদিন থেকে ওই সব অধ্যাদেশ বা আইন অবৈধ ঘোষিত হয়েছে সেদিন থেকেই কার্যকর দেখাতে হবে। তিনি বলেন, এক রায়ে এত আইন বা অধ্যাদেশ অবৈধ ঘোষণার কোনো নজির নেই। তাই সংকটের মুখে পড়বে সরকার। তিনি আরো বলেন, কোনো আইন অবৈধ ঘোষিত হওয়ার পর সে আইনে করা কাজও অবৈধ ও বাতিলযোগ্য।
সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে ১৯৮১ সালে হত্যার পর রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন সাবেক বিচারপতি আবদুস সাত্তার। কিন্তু ১৯৮২ সালে তাঁর কাছ থেকে ক্ষমতা নেন তখনকার সেনাবাহিনী প্রধান এইচ এম এরশাদ। ওই বছরের ২৪ মার্চ জারি করা হয় সামরিক শাসন। এরপর জারি হতে থাকে একের পর এক সামরিক ফরমান ও অধ্যাদেশ। পরে এসবের বৈধতা দিতে সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী আনা হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত এরশাদের সামরিক শাসনকালের সব কাজের বৈধতা দেওয়া হয়।
সপ্তম সংশোধনী বাতিল-সংক্রান্ত মূল রায়টি লিখেছেন বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। তাঁর সঙ্গে সম্মতি প্রকাশ করেন আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিরাও। এরপর তা প্রকাশ করা হয়।
বহুল আলোচিত সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের রায় দেওয়ার পর ২০১১ সালের ৩ জুলাই সংবিধান সংশোধন করে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়। আর এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে পঞ্চম সংশোধনীর পাশাপাশি সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে সামরিক শাসনকে বৈধতা ও দায়মুক্তি দেওয়া-সংক্রান্ত বিধান তুলে দেওয়া হয়।
এদিকে পঞ্চম সংশোধনী রায় বাতিল করা হলেও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত জনস্বার্থে জারি করা যেসব সামরিক ফরমান ও আদেশ আগে মার্জনা করা হয়েছিল, তা ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। এর মধ্যে এ ব্যাপারে সংসদ প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু সরকার এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় আরো সময় চেয়ে আবেদন করা হয়। সরকারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ সময় বাড়িয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু সপ্তম সংশোধনী বাতিল করার রায়ে ১৯৮২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে করা কোনো আইনকে বৈধতা দেওয়া হয়নি। সে সময়কার সব আইন, অধ্যাদেশ ও সামরিক ফরমান অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করা হয়। তবে এ রায়ের আগ পর্যন্ত ওই সময়ের করা আইনের মাধ্যমে যেসব কাজ করা হয় তা শর্ত সাপেক্ষে ক্ষমা করা হয়েছে। এ বিষয়ে আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়, সামরিক শাসকদের কাজকে বৈধতা দেওয়া হলে প্রকারান্তরে সামরিক শাসনের জন্য উৎসাহিত করা হয়।
আপিল বিভাগের রায়ে এরশাদের সে সময়কার আইন বাতিল করা হলেও এখনো তা বলবৎ রয়েছে। যেমন আয়কর আইন। এ আইনেই কাজ চলছে। কিন্তু আপিল বিভাগের রায়ের পর ওই আইনে যেসব কাজ হচ্ছে তা বাতিল ও অবৈধ হয়ে যাবে। এটা হলে বিপাকে পড়বে রাষ্ট্র। শুধুই আয়কর আইন নয়, এরশাদের ওই সময়কার করা আইনের মধ্যে যেসব আইন এখনো কার্যকর, সেসব আইনে করা কাজ প্রশ্নের মুখে পড়বে। আর এ কারণেই সংবিধান বিশেষজ্ঞদের উৎকণ্ঠা। দেশে বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টির আগেই প্রয়োজনীয় আইনগুলোকে কার্যকর দেখাতে নতুন আইন জাতীয় সংসদে পাস করতে হবে বলে তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা।

No comments

Powered by Blogger.