সহিংসতা- এ যেন আমাদেরই ঝলসে যাওয়া মুখ

দুটো সংবাদই আমরা জেনেছি আগে। আসিফের ঘটনাটি জেনেছি ফেসবুকের পাতা ঘুরে, আর অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার ইডেনের ছাত্রীটির ঘটনা জেনেছি মিডিয়ার মাধ্যমে। গতকাল আমরা জনা আটেক সহকর্মী গিয়েছিলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
আমরা প্রথমে গিয়েছিলাম হত্যাচেষ্টার শিকার আসিফ মহিউদ্দিনকে দেখতে, আমাদের সঙ্গে ছিলেন সহযোদ্ধা বন্ধু বাকী বিল্লাহ—আসিফের বন্ধু। আসিফ ব্লগার, অ্যাকটিভিস্ট। আমাদের এই আটজনের কেউই আসিফকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। ব্যক্তিগতভাবে চেনা-অচেনার ধারাপাত এখানে গুরুত্বপূর্ণও নয়। কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই তাঁর অ্যাকটিভিজম সম্পর্কে জানি। নিজের মত প্রকাশে অত্যন্ত দৃঢ়। ধর্ম নিয়ে, সমাজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে, আছে দর্শন। অত্যন্ত দৃঢ়ভাবেই তিনি সেটি প্রকাশ করেন ফেসবুকে ও ব্লগে। সামহোয়ারইনসহ আরও কিছু ব্লগে তাঁর লেখা পড়েছি। ফেসবুকে তাঁর লেখা নোটে নিয়ে বিভিন্নজনের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কও চোখে পড়েছে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানুষের সবচেয়ে বড় স্বাধীনতার একটি। যাঁরা নিয়মিত না হলেও মাঝেসাঝে ব্লগ-পাড়ায় বেড়িয়ে আসেন, তাঁদের সবাই আসিফের লেখার সঙ্গে কমবেশি পরিচিত। বাংলা ভাষায় ব্লগ-সংস্কৃতি নিয়েও নানা ধরনের মতভেদ আছে, থাকতে পারে; যেখানে হয়তো যুক্তির বাহাসের চেয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণের তরবারি বাজে বেশি। তার পরও ব্লগকে আমরা মুক্তচিন্তা, যুক্তি-তর্কের একটি বড় পরিসর হিসেবেই দেখি। এই সমাজ-রাষ্ট্রে নানা মত-পথ আছে, আর আছে বলেই সমাজ গতিশীল। যুক্তি-তর্ক আদর্শের জায়গায় সহমত, দ্বিমত কিংবা বিরুদ্ধমতের চলন সব সময়, সব জায়গাতেই আছে। কিন্তু কারও মত প্রকাশের বিরোধিতা করতে গিয়ে কাউকে শারীরিকভাবে আঘাত করা কিংবা কাউকে হত্যাচেষ্টা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।
১৯৬৪-৬৫ সালে দুনিয়াজুড়ে গড়ে ওঠা ফ্রিডম অব স্পিচ আন্দোলন এবং এর পরবর্তী সময়ে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকারের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়েছিল বিশ্বের মুক্তিকামী বেশির ভাগ মানুষ। কিন্তু সেই আন্দোলনের ৫০ বছর পরও স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার মানুষের আসেনি। তাই আসিফরা আক্রমণের শিকার হন। অন্যরা হয়তো আক্রমণের শিকার হওয়ার ভয়ে মত প্রকাশে বিরত থাকেন। তাই স্বাধীন মত আর পথ পায় না। আসিফের ওপর হামলাকারীরা এখনো ধরা পড়েনি। তারা আসিফের চোখ বেঁধে হামলা করেছে, যেন আসিফ তাদের চিনতে না পারেন।
হাসপাতালের বেডে ঘাড়ে ও পিঠে ব্যান্ডেজ নিয়ে শুয়ে থাকা নিশ্চুপ আসিফ এবং তাঁর পাশে স্বজনদের বিমর্ষতা দেখে এই চিন্তাগুলোই জোরালোভাবে মাথায় আঘাত করছিল। ড. হুমায়ুন আজাদকেও আক্রমণের শিকার হতে হয়েছিল। কবি দাউদ হায়দার এবং লেখিকা তসলিমা নাসরিনকেও দেশ ছাড়তে হয়েছে। সহিংসতার মধ্য দিয়ে কণ্ঠ রুদ্ধ করার চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। কিন্তু যুক্তির মুক্তি ঘটতে না দেওয়া স্বৈরাচার। এটি গণতান্ত্রিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করে। আমরা আর কত দিন কণ্ঠকে স্তব্ধ, লেখনকে রুদ্ধ হতে দেব?

দুই.
এক সহিংস ঘটনার শিকার আসিফের ক্ষতকে আঁকড়ে ধরে আমরা হাঁটতে থাকলাম বার্ন ইউনিটের দিকে। সেখানে চিকিৎসাধীন আছেন ইডেন কলেজের ছাত্রীটি, তিনি মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্যতম ঘটনাগুলোর একটির শিকার হয়েছেন তিনি। অ্যাসিডে ঝলসে দেওয়া হয়েছে তাঁর দেহ। প্রথমে ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে, তারপর মারা হয়েছে অ্যাসিড। সেই কেবিনের সামনে বসে ছিল পুলিশ। কেবিনের দরজায় একজন দাঁড়ানো। জানলাম, তিনি সেই মেয়ের ভাই। তিনিই জানালেন, মেয়েটি মানুষের কণ্ঠস্বর শুনলেই চমকে চমকে উঠছেন। ভয় পাচ্ছেন। এটি জানার পর কেবিনের ভেতরে যেতে আমরা চাচ্ছিলাম না।
কিছুটা পরে, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে, মেয়েটির ভাইয়ের অনুরোধে মনে কিছুটা সাহস নিয়েই রুমে ঢুকলাম আমরা। ঢুকেই মনে হলো, না দেখলেই মনে হয় ভালো ছিল। মাথা থেকে পুরোটাই পোড়া মুখ, দুই চোখ বন্ধ, সারা গায়ে ব্যান্ডেজ মাখা মেয়েটির দিকে একবার তাকিয়েই আমরা দ্রুত সবাই সবার দিকে তাকিয়ে একটি বড় ধরনের বাস্তবতা জোর করে দূরে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। সঙ্গে সঙ্গেই মনে হলো, এই অ্যাসিড যেন আমাদের সবার মুখেই মারা হয়েছে। এই অ্যাসিডে ঝলসে গেছি আমরা সবাই। এ দৃশ্য সহ্য করার মতো নয়। এ আঁধার চোখের সামনে থেকে সরতে চায় না।
এই ঘটনার বিচার চেয়ে পরের দিনই আন্দোলনে নেমেছেন ইডেন কলেজের ছাত্রীরা। অপরাধী ধরা পড়েনি এখনো। অপরাধী যত দিন ধরা না পড়বে, আমরা তত দিন সরকারের মুখে অ্যাসিড নিক্ষেপকারীর প্রতিচ্ছবিই দেখতে পাব।
দুটো সহিংসতার ধরন ও কারণ ভিন্ন। কিন্তু দুটোই আমাদের বিচলিত করেছে। দুই ধরনের ক্ষমতার দাপট। এই সমাজে একজন স্বাধীন মত প্রকাশে বিশ্বাসী আসিফের জীবন যেমন হুমকির মুখে, তেমনি বিয়েতে রাজি না হওয়ার বিষয়ে তাঁর মত প্রকাশ করায় সেই মেয়েকে আক্রান্ত করা হয়েছে। আসিফ বর্তমানে আশঙ্কামুক্ত হলেও মেয়েটি নন। কারণ, তাঁর ক্ষত অনেক বেশি। দেহে আঘাত করেও মেয়েটির ওপর আক্রমণকারীর ক্রোধ কমেনি, তাঁর মুখে নিক্ষেপ করা হয়েছে অ্যাসিড। এ ধরনের সন্ত্রাস বন্ধ কবে হবে? কী করলে হবে? দেশে আইন আছে, তবু কমছে না অ্যাসিড-সন্ত্রাস।
অ্যাসিড-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে করা বিচারাধীন ৪৪টি মামলার মধ্যে মাত্র দুটো নিষ্পত্তি হয়েছে গত এক বছরে, যদিও অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন অনুযায়ী, ৯০ কর্মদিবসের মধ্যে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের মামলার বিচার শেষ করার কথা। গত এক বছরে নিষ্পত্তি হওয়া দুটো মামলার সব আসামিই খালাস পেয়েছে। যদিও গত ১০ বছরে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের মামলায় ১৩ জন আসামির মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, অবশ্য এখনো কারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়নি, আর এই সময়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে ১০২ জনের (সূত্র: প্রথম আলো, ১৭ জানুয়ারি ২০১৩)।
মানবতার বিরুদ্ধে এ ধরনের অপরাধ আমাদের আরও বেশি নিরাপত্তাহীন করে, পরস্পরের প্রতি তৈরি হওয়া বিশ্বাস, সম্মান আর ভালোবাসায় মোড়া সম্পর্কটিতে সন্দেহ আর অবিশ্বাসের চোখ ঘোরে, চোখ মেললেই যেন দেখতে পাই সেই পোড়া মুখ, বন্ধ চোখ। এ যেন আমাদেরই পোড়া মুখ, আমাদেরই আক্রান্ত কাঁধ।
 লেখকেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, ব্লগার ও রাজনৈতিক কর্মী।

No comments

Powered by Blogger.