জনগণ অর্থ অপচয় দেখতে দেখতে ক্লান্ত ॥ গোল্ডস্টেইন- বিশ্বব্যাংকের নতুন কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে আসছেন সালমান জহির

পদ্মা সেতু প্রকল্প বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর এ্যালেন গোল্ড স্টেইন বলেছেন, জনগণ অর্থের অপচয় দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গেছে। পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংকের ভূমিকাকে জনগণ সাধুবাদ জানিয়েছে।
আমরা শক্তিশালী ভূমিকা রাখার কারণে সাধারণ মানুষের কাছে প্রশংসিত হচ্ছি। পদ্মা সেতু প্রকল্পসহ সকল প্রকল্পে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে জনগণ আগ্রহী। পদ্মা সেতু প্রকল্পে আমি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত ছিলাম। আমি চেয়েছিলাম অর্থ ব্যবহারে যেন স্বচ্ছতা থাকে। আমার নাম প্রকল্পটিতে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। শনিবার রাজধানীর শেরেবাংলানগরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) সম্মেলনকক্ষে বাংলাদেশ কান্ট্রি পারফরমেন্স এ্যান্ড রেজাল্টস রিভিউ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব আরস্ত খান একটি প্রতিবেদন উপস্থাপনা করেন। এ সময় বিশ্বব্যাংকের অপারেশন কর্মকর্তা লিসান্ড্রো মার্টিন, ইআরডি সচিব আবুল কালাম আজাদ, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালক শাহীন আনাম বক্তব্য রাখেন। এছাড়া বিশ্বব্যাংক, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও বিভাগের উর্ধতন কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন।
গোল্ড স্টেইন আরও বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার কারণে দোকান থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট সব জায়গায় বাংলাদেশের মানুষ আমাদের প্রশংসা করছে। বাংলাদেশের মানুষ দেখতে চায়, সরকার স্বচ্ছতার সঙ্গে অর্থ ব্যয় করছে, যাতে সেটি জিডিপি বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সংস্থাটির এক মাস সময় বেঁধে দেয়ার বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কান্ট্রি ডিরেক্টর বলেন, সরকার পদ্মা সেতু প্রকল্পসহ অন্যান্য প্রকল্পের অর্থ কার কাছ থেকে নেবে সেটি সম্পূর্ণ সরকারের বিষয়। সরকার স্বাধীনতা আছে, বিশ্বব্যাংক কিংবা অন্যান্য দাতা সংস্থার কাছ থেকে অর্থ নেয়ার। নাকি বিকল্প অর্থায়ন হিসেবে নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ করবে। সেটি সম্পূর্ণ তাদের বিষয়। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দল দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) চিঠি দিয়েছে। দুদকের পক্ষ থেকে চিঠির জবাব দেয়ার পর পর্যালোচনা করে বিশেষজ্ঞ দলের পক্ষ থেকে প্রতিবেদন দেয়া হবে। তবে এই দলের সঙ্গে আমাদের সরাসরি যোগাযোগ নেই। আশা করছি জানুয়ারির মধ্যেই প্রতিবেদন পাওয়া যাবে।
ইআরডি সচিব আবুল কালাম আজাদ দাতাদের প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়া জটিলতার কারণে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, প্রকল্পগুলোতে সরকারী বিনিয়োগের অর্থ ছাড় শতভাগ হচ্ছে। কিন্তু দাতাদের অর্থছাড়ে রয়েছে দীর্ঘ প্রক্রিয়া। যেখানে প্রকল্প শুরু থেকে কার্যাদেশ দেয়া পর্যন্ত গড়ে ১৪০ দিন সময় লাগে, সেখানে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের অনুমোদন নিতে সময় লাগে ২০০ দিনের বেশি। কিন্তু বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর ওপর দোষ দেয়া হয় প্রকল্প দেরি করার জন্য। এসব সংস্থাকে মূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু সমস্যা উভয় দিক থেকেই রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দুর্নীতির কারণে প্রতিটি বিভাগে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু এজন্য অর্থ আটকে রাখা সমাধান নয়। বরং কোন চলমান প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তা পাস কাটিয়ে প্রকল্পটি চলমান রেখে, দুর্নীতির তদন্ত বা স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কাজ চলতে পারে কিনা সে বিষয়ে দাতাদের ভেবে দেখতে হবে।
এদিকে এ্যালেন গোল্ড স্টেইন চলতি মাসে বাংলাদেশে তার তিন বছরের মেয়াদ পূর্ণ করেছেন। ২০০৯ সালের নবেম্বরে ঢাকায় মিশন প্রধানের দায়িত্ব নেন তিনি। তার স্থলে দায়িত্ব নিচ্ছেন সালমান জহির। ভারতীয় নাগরিক সালমান বর্তমানে সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের কর্মসূচী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও নেপালের দায়িত্ব পালন করবেন।
বিশ্বব্যাংক ২০১২ সাল পর্যন্ত তাদের মূল্যায়নে বলেছে, এতে দেখা গেছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে অবকাঠামো খাতে। আর সবচেয়ে ভাল অবস্থা রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাত। মাঝারি অবস্থানে রয়েছে ওয়াটার স্যানিটেশন, লোকাল সার্ভিস ডেলিভারি এবং আরবানাইজেশন। আবার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে চারটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন। এগুলো হচ্ছে, ডিজএ্যাবিলিটি এ্যান্ড চিলড্রেন এ্যাট রিস্ক প্রজেক্ট, ইনভেসমেন্ট প্রমোশন এ্যান্ড ফাইন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি (আইপিএফএফ) প্রকল্প, ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই এ্যান্ড স্যানিটেশন এবং আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর ইনহ্যান্সিং এক্সসেস টু সার্ভিসেস প্রজেক্ট। সূত্র জানায়, ২০১১ সালে বাংলাদেশের জন্য চার বছরের সহযোগিতা কৌশল ঘোষণা করে বিশ্বব্যাংক। এ সময় ২০১১-১৪ সালের মধ্যে পদ্মা সেতু বাদে ৪শ’ কোটি ডলার ঋণ ও অনুদান দেয়ার ঘোষণা দেয়। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীর গতির কারণে প্রতিশ্রুত আর্থিক সহায়তা দিতে পারেনি বিশ্বব্যাংক। সহযোগিতা কৌশল ঘোষণার প্রথম দুই বছরে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ১১৫ কোটি ডলার ঋণ ও অনুদান দিয়েছে। এর মধ্যে ২০১১ সালে ৪৫ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। এর মধ্যে ঋণ ৩৫ কোটি ডলার। অন্যদিকে অনুদান দেয় ১০ কোটি ডলার। সহযোগিতা কৌশল ঘোষণার দ্বিতীয় বছরে ৭০ কোটি ডলার ঋণ ও অনুদান দিয়েছে সংস্থাটি। এর মধ্যে ঋণ ৬৩ কোটি ডলার ও অনুদান হিসাবে বাংলাদেশ পেয়েছে ছয় কোটি ৮০ লাখ ডলার।

No comments

Powered by Blogger.