মুক্তিযোদ্ধার বাঁচার লড়াই - জুতা মেরামত করেন এখন ধীরেন্দ্রনাথ by অসীম মণ্ডল

এক সময়ের নিভৃত কড্ডার মোড় এলাকাটি এখন বঙ্গবন্ধু সেতু সংযোগ সড়কের সুবাদে শত শত যানবাহন আর হাজারো মানুষের ভিড়ে মুখরিত থাকে সারাক্ষণ। ছোট-বড় অসংখ্য দোকান আর জনারণ্যের ভিড়ে ফুটপাতের পাশে একটি দোকানের বারান্দায় বসে নিবিষ্ট মনে জুতা পলিশ আর মেরামতের কাজে ব্যস্ত ধীরেন্দ্র নাথ দাস। রোদ বৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচাতে একটি ছাতা টানিয়ে রাখলেও সেই ছাতার এমনই জীর্ণদশা যে সেটি কোনো কাজেই আসে না। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে জীবিকার টানে যে লোকটি দিনভর মানুষের জুতা সেলাই ও রং করছেন, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, বাংলা মায়ের এক গর্বিত সন্তান।
অতিমূল্যের বাজারে শুধু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পাওয়া ভাতায় তো আর সংসার চলে না। তাই বাধ্য হয়েই ধীরেন্দ্র নাথ বেছে নিয়েছেন এ পেশা। কেউ কেউ তাঁকে ধীরেন চর্মকার বলেও ডাকে। চর্মকারের কাজে কোনো আক্ষেপ নেই তাঁর। তবে না জেনেই হয়তো কোনো রাজাকারের জুতাও পলিশ করতে হয় কি না সে নিয়ে মর্মপীড়ায় ভোগেন তিনি।
সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদ ইউনিয়নের চরক্ষিদির গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্র নাথ দাস তিন বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পঙ্গুপ্রায়। সুচিকিৎসার অভাবে কোমরের হাড়ে জটিল সমস্যা দেখা দিয়েছে। ফলে ক্র্যাচে ভর দিয়ে কোনো রকমে চলাফেরা করেন তিনি।
ধীরেন জানান, তাঁর বাবা মৃত রতন চন্দ্র দাস নৌকা পারাপার করে কোনো রকমে সংসার চালাতেন। ধীরেনের বয়স যখন ১৬ বছর, তখন শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। তখন রাজাপুর হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র তিনি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি বই-খাতা ফেলে হাতে তুলে নেন অস্ত্র। ১০ নম্বর গ্রুপের সঙ্গে তিনি চলে যান ভারতে। ট্রেনিং শেষ করে ৯ নম্বর গ্রুপের সঙ্গে দেশে ফিরে ঝাঁপিয়ে পড়েন শত্রুর মোকাবিলায়। ৭ নম্বর সেক্টরের আওতায় তিনি বিভিন্ন স্থানে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। সমেশপুর ও উল্লাপাড়াসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সমেশপুরের যুদ্ধে তাঁর সহযোদ্ধা হাবিবের শহীদ হওয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে ধীরেন বলেন, 'হয়তো সে যুদ্ধে হাবিবের মতো আমার পরিণতি হলেও ভালো হতো। তাহলে স্বাধীন দেশের মাটিতে এমন দুর্ভাগ্য আমাকে বয়ে বেড়াতে হতো না। হাবিবের জন্য আমরা মুক্তিযোদ্ধারা মিলে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছিলাম। কিন্তু আমি মারা গেলে কেউ হয়তো জানবেই না, মনে রাখা তো দূরের কথা।'
ধীরেন জানান, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে তিনি এসএসসি পাস করেন। এরপর স্বাধীন দেশের মাটিতে বুকভরা আশা নিয়ে একটি চাকরির জন্য মরিয়া চেষ্টা চালান। কিন্তু চাকরি পাননি। এরপর বিয়ে করেন, ক্রমান্বয়ে তিন কন্যাসন্তানের বাবা হন। পাঁচজনের সংসার চালাতে গিয়ে একসময় তিনি বেছে নেন শ্রমিকের পেশা। মাঝেমধ্যে নৌকা পারাপারও করেছেন। সামান্য পৈতৃক বসতভিটা ছাড়া ফসলি কোনো জমি নেই ধীরেনের। তাই অন্যের জমিতে শ্রম বিক্রি করতে শুরু করেন তিনি। শ্রম বিক্রি আর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দিয়ে কোনোভাবে সংসার চললেও তিন বছর আগের সড়ক দুর্ঘটনায় অনেকটা পঙ্গু হয়ে পড়েন। এরপর দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে সঞ্চিত সামান্য অর্থও নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পারেননি। দুর্ঘটনার পর থেকে শ্রম বিক্রি করতে না পারায় সংসার চালাতে অবশেষে বেছে নেন চর্মকারের পেশা।
সদর উপজেলার চরক্ষিদির গ্রামে গিয়ে কথা হয় ধীরেন্দ্র নাথের স্ত্রী মিনতি দাসের সঙ্গে। পাটকাঠি, পলিথিন ও বাঁশ দিয়ে মোড়ানো ছোট্ট একটি ছাপড়াঘরে তাঁদের বসবাস। মিনতি জানান, সড়ক দুর্ঘটনার পর তাঁর স্বামী দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন। সেই দুঃসময়ে নিরুপায় হয়ে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে তিনি সংসার চালিয়েছেন। ওই সময় তাদের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। কথোপকথনের এক পর্যায়ে মিনতি জানালেন, ধারদেনা করে হলেও তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। ছোট মেয়ের জামাই এখন দেখাশোনার জন্য তাঁদের সঙ্গেই রয়েছেন। স্থানীয় বাজারে একটি সেলুন খুলে বসেছেন। এতে ছেলে না থাকার দুঃখটা কিছুটা হলেও কমেছে।
মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন বলেন, 'চর্মকারের পেশায় এতটুকু দুঃখ নেই, তবে জীবনের শেষপ্রান্তে এসে একটু সম্মানজনক অবস্থান কিংবা সামান্য স্বাচ্ছন্দ্য পাইতে ইচ্ছা করে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে না হলেও স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে এটুকু চাইবার অধিকার আমার আছে।'

No comments

Powered by Blogger.