নারী নির্যাতন গর্হিত অপরাধ by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

সাম্প্র্রতিককালে সংঘটিত অন্যতম ঘৃণ্য এক অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর দিলি্লর জনতা। এক সপ্তাহ আগে নয়াদিলি্লর বাসে গণধর্ষণের পর এক ছাত্রীকে বাস থেকে ফেলে দেওয়ার মর্মান্তিক ঘটনার পর থেকে প্রতিবাদের যে ঝড় বইছে, তা যেন ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে ভারতের সীমানা ছেড়ে বিশ্বজুড়ে।
প্রতিবাদের এত উত্তাপের কারণ, এটা অমানবিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, অন্ধত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। প্রতিবাদকারীরা নিতান্তই সাধারণ মানুষ। যারা সবাই অন্যায়ের প্রতিবাদ সবসময় মন খুলে করতে পারে না। কিন্তু এবার বিষম এক মনোযাতনায় তারা বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়। কারণ এই ঘটনা আজ সবার ঘরের ঘটনা হতে পারত। এই ঘৃণ্যতম অপরাধ সংঘটিত হতে পারত নিজ বাড়ির নারীদের সঙ্গেও। তাই এই প্রতিবাদ।
শুধু দিলি্লতে নয়; বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে ধর্ষণপ্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই অপকর্ম বৃদ্ধির মূল কারণ অপরাধীদের শাস্তির বিধান যথাযথভাবে কার্যকর না করা। অনেক ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়, ধর্ষণের শাস্তিস্বরূপ ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষিতার বিয়ে দিয়ে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আবার কোথাও উভয়কেই শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এ কাজটি যে ইসলামে নিষিদ্ধ এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন_ তারও বোধ অনেকেই হারিয়ে ফেলে। কেননা, এ কাজ সংঘটিত হয় পুরুষ কর্তৃক জোরপূর্বক। এ জন্য ধর্ষকই অপরাধী; ধর্ষিতা নয়। ইসলাম এই কথাটিরই সমর্থন করে। ইসলাম বলে, কাজটি যদি নারীর অমতে হয়, তাকে যদি এ কাজে বাধ্য করা হয় এবং সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে নারীর অসহায়ত্ব ও অমত সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে, তাহলে এ জন্য নারী কেন শাস্তি পাবে না। এ জন্য ধর্ষক পুরুষই শাস্তি পাবে। সে অবিবাহিত হলে তাকে একশ' বেত্রাঘাত করা হবে। আর সে বিবাহিত হলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। আর এ শাস্তি প্রদানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের; কোনো নাগরিক বা অন্য কারও নয়। এখানে নারীর অব্যাহতি প্রসঙ্গে কোরআনে-কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, 'যে তাদেরকে ব্যভিচারে বাধ্য করে তাহলে তাদের জবরদস্তির পর আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।' (সূরা নূর :৩৩)
শুধু ধর্ষণ নয়; বর্তমানে বিশ্বজুড়েই নারীরা কোনো না কোনোভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। নির্যাতনের আকার, ধরন, প্রকৃতি ও মাত্রার যেন শেষ নেই। প্রতিদিনই নিত্যনতুন চেহারায় তা প্রকাশ পাচ্ছে। যুগ যুগ ধরে চলছে এই অমানবিক নৃশংসতা। শহর-গ্রামে যে কত বিচিত্র পন্থায় নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে, তার হিসাব নেই। এখনও ঘরে-বাইরে, শিক্ষাঙ্গনে, কর্মস্থলে নারীদের নানা প্রকার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। সুযোগ পেলেই এক শ্রেণীর পুরুষ নারীর প্রতি অশোভন আচরণ করে বসে। তবে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ একেবারেই যে হয়নি_ তা নয়। কিন্তু সাফল্য আসেনি। নানা উপায়ে, নানা ফন্দি-ফিকিরে চলছে নারী নির্যাতন। নির্যাতনের ফলে অনেকের মৃত্যু হয়। কেউ আত্মহত্যায় বাধ্য হয়। নারী নির্যাতনের এই চিত্র আমাদের সমাজ ব্যবস্থার অবক্ষয়ের প্রকাশ মাত্র। নারী নির্যাতনের মূলে রয়েছে মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ, সম্প্র্রীতি ও ভালোবাসার অভাব। দেশে নারী নির্যাতনবিরোধী কঠোর আইন আছে। কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগের অভাবে এই পৈশাচিক সহিংসতা বন্ধ হচ্ছে না।
'নারী নির্যাতনের শিকার হওয়ার আগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে' বলে অনেকেই এ বিষয়ে পাশ কাটিয়ে যান। আবার অনেকেই ভাবেন, যাক বাবা! আমি তো নিরাপদে আছি! এ ধরনের আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনা ছেড়ে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা জানি, সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ও বিজাতীয় অপসংস্কৃতির প্রভাব, সুস্থ বিনোদনের অভাব কিংবা অন্যান্য কারণে সমাজে বখাটেদের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু তাদের সংখ্যা অবশ্যই সুশীল ও সভ্যদের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায়নি। এমতাবস্থায় প্রতিটি পরিবার যদি নিজ নিজ দায়িত্ব মনে করে এসব বখাটেকে খুঁজে বের করে সংশোধনের ব্যবস্থা নেয়, তাহলেই নারী নির্যাতন প্রতিরোধের আন্দোলন সফল ও সার্থক হবে। আজ বখাটে বলে যাদের সম্বোধন করছি, তারাও তো কোনো না কোনো পরিবারেরই সদস্য। এ ক্ষেত্রে পরিবারে ধর্মীয় অনুশাসন অনুসরণের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।
আমরা যে যেই ধর্মের অনুসারী হই না কেন; আমরা যদি প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্মের অনুশাসন কঠোরভাবে মেনে চলি, তাহলে নারী নির্যাতনের মাত্রা হ্রাস করা সম্ভব। কারণ, প্রতিটি ধর্মেই নারী নির্যাতন প্রতিরোধের উপায় বলা আছে। বলা আছে এর পরিণাম ও পরিণতির কথা। বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম নারীর মর্যাদাকে অনেক উচ্চাসন প্রদান করেছে। ইসলাম চায় নারী নির্যাতনের সব পথ বন্ধ করতে। ইসলামে সব ধরনের অত্যাচারকে 'চরম অন্ধকার' বলে অভিহিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, অত্যাচার কিয়ামতের দিনে আঁধাররূপে প্রকাশ লাভ করবে। অত্যাচারিতের ফরিয়াদে ও কান্নায় আল্লাহতায়ালার আরশ কেঁপে ওঠে।
ইসলাম পরিপন্থী এসব নির্যাতন বন্ধের উপায় খুঁজে বের করে সমস্যার সমাধানকল্পে ধর্মপ্রাণ জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে চেষ্টা চালানো দরকার। আরও দরকার নারী নির্যাতন বন্ধে অভিভাবক মহলের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের। কারণ পরিবারের সবাইকে সর্বাগ্রে এ কথা উপলব্ধি করতে হবে যে, নারী-পুরুষ মিলে যে ঘর-সংসার, বহু ঘর নিয়ে যে মুসলিম সমাজ, সেখানে প্রত্যেকেরই গুরুত্ব, মর্যাদা, অধিকার ও ভূমিকা রয়েছে। এখানে নারীকে কম আর পুরুষকে বেশি মূল্যায়নের কোনো সুযোগ নেই। পুরুষ নারীর প্রতিপক্ষ নয়। নারীও পুরুষের প্রতিপক্ষ নয়। বরং দু'য়ে মিলেই সমাজ।
muftianaet@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.