জাকাতের রঙিন শাড়ি বনাম কাফনের সাদা কাপড় by আমীন আল রশীদ

নোয়াখালীর রাইপুর গ্রামের ময়না বেগম কিংবা লালমনিরহাটের আদিতমারি উপজেলার চরমইষা গ্রামের জরিনা বেগম অথবা নাম না জানা ষাটোর্ধ্ব যে বৃদ্ধা গিয়েছিলেন রাজধানীর ফকিরাপুলে জাকাতের কাপড় আনতে, বৃহস্পতিবার সকালেও হয়তো তারা ভেবেছিলেন ঈদের সকালটায় নতুন কাপড় পরে মনকে প্রফুল্ল করবেন। কিন্তু হায়, জাকাতের রঙিন শাড়ির চূড়ান্ত পরিণতি এখন কাফনের সাদা কাপড়।

অবশ্য জাকাত আনতে গিয়ে পদদলিত হয়ে গরিব মানুষের এরকম নিহত কিংবা আহত হবার এই ঘটনা বিচ্ছিন্ন কিছু নয় কিংবা দৈবাৎক্রমে ঘটে যাওয়া কোনো দুর্যোগও নয়। জাকাত আনতে গিয়ে এরকম গরিব মানুষের মৃত্যুর ঘটনা প্রতি বছর দুই ঈদের আগেই গণমাধ্যমের খবর হয়। কিন্তু এই জাকাতের মধ্য দিয়ে যিনি জাকাত দেন তিনি কতটুকু লাভবান হন বা তার আসলে উদ্দেশ্য কী থাকে এবং বিপরীতে যিনি বা যারা এই জাকাত নেন, তাদের জীবনেই বা কী পরিবর্তন আসে, সেটি নিয়ে ভাববার সময় হয়তো অনেকেরই হয় না। অধিকাংশ জাকাত প্রদানকারী এ নিয়ে ভাবতেও চান না।

সম্পদশালী মুসলমানরা জাকাত দেন ইসলামের নির্দেশ পালনের জন্য- এটি ধরে নিয়ে যদি আলোচনা করা হয়, তাহলেও দেখা যাবে পবিত্র কোরানের অসংখ্য জায়গায় জাকাতের প্রসঙ্গ আছে এবং যতবার নামাজের কথা বলা হয়েছে, তার মোটামুটি সব জায়গায়ই জাকাতের প্রসঙ্গ আছে। যেমন সুরা বাকারার ৪৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো এবং জাকাত দাও এবং যারা রুকু করে তাদের সঙ্গে রুকু করো।’ সুরা রুমের ৩৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : ‘মানুষের ধনসম্পদ বৃদ্ধির জন্য তোমরা যা সুদে দিয়ে থাক, তা আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি পায় না। কিন্তু তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য জাকাত দিয়ে থাকে, তাদেরই ধনসম্পদ বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।’

জাকাত শব্দের সরাসরি অর্থ হচ্ছে পবিত্র হওয়া, সঠিক হওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া। তার মানে যিনি জাকাত দেবেন, তার ধনসম্পদ পবিত্র হবে, বৃদ্ধি পাবে এবং তিনি যে আল্লাহর নির্দেশ সঠিকভাবে মানছেন, সেটির প্রমাণ হবে। অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে স্বচ্ছল মানুষেরা জাকাত হিসেবে যে সম্পদ সমাজের বিত্তহীন ও গরিব মানুষকে দান করবেন, তার ফলে বিত্তহীন মানুষেরা অর্থপ্রাপ্ত হবেন এবং ক্রমান্বয়ে গোটা সমাজে অভাবি মানুষের সংখ্যা কমে আসবে। কিন্তু জাকাত আনতে গিয়ে যখন গরিব মানুষ পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মারা যায়, তখন বুঝতে হবে যিনি জাকাত দিচ্ছেন, তার নিয়তে গরমিল আছে। তিনি প্রকৃতই তার সৃষ্টিকর্তাকে খুশি করবার জন্য এবং জাকাত দিলে তার সম্পদ পবিত্র হবে, এমন বিশ্বাসে তিনি জাকাত দিচ্ছেন কি না, সেই প্রশ্নও উঠবে।

মহানবী স. যখন শাসনভার গ্রহণ করেন তখন তিনি জাকাতকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং জাকাত আদায়ের জন্য কর্মচারী নিয়োগ করেন। জাকাতের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ রাষ্ট্রের দুঃস্থ, মিসকিন, গরিব এবং বেকারদের প্রতিপালনে ব্যয় হত। জাকাতের মাল সংগ্রহ ও বণ্টনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অধিকার ছিল না, রাষ্ট্রই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করত। মহানবীর পরে খোলাফায়ে রাশেদীনদের আমলেও এ নিয়ম চালু ছিল। আমাদের দেশে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি জাকাত বোর্ড থাকলেও এটি কতটুকু কার্যকর তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এমনকি জাকাত বোর্ডে জমা হওয়া অর্থ বণ্টনে স্বজনপ্রীতি এবং লুটপাটেরও অভিযোগ আছে।

কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে সারা দেশেই জাকাত দেয়ার চিত্র মোটামুটি একইরকম। ধনী মানুষেরা তাদের সম্পদের একটা অংশ যখন গরিব মানুষের মাঝে বণ্টন করেন, তখন তারা এটি জানান দেন। কোনো কোনো এলাকায় সকালে মাইকিং করা হয় যে, বাদ আসর অমুক স্থানে জনদরদী অমুক ভাই জাকাতের কাপড় ও লুঙ্গি দেবেন-এজন্য সবাইকে উপস্থিত থাকতে বলা হয় অথবা যদি মাইকিং নাও করা হয়, তারপরও ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশের যেকোনো প্রান্তেই  ‘জাকাত অনুষ্ঠানের’ আয়োজন করা হোক না কেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে তা আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে এবং সঙ্গত কারণেই কাপড়ের তুলনায় আগত মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়ায় ‘কর্তৃপক্ষ’ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে লাঠিপেটা করে এবং তখন পদদলিত হয়ে জরিনা বেগমদের রুহু বেরিয়ে যায়।

প্রতি রমজানের শুরুতেই কাপড়ের দোকানের সামনে একটা অদ্ভুত ব্যানার লক্ষ্য করা যায়, যেখানে লেখা থাকে-‘এখানে জাকাতের কাপড় পাওয় যায়।’ তার মানেই হলো, সমাজে এটি একটি প্রতিষ্ঠিত ধারণা যে, জাকাতের কাপড় মানেই হলো শস্তা কাপড়। যার উপরে এই বছর ১০ হাজার টাকা জাকাত ফরজ হয়েছে, তিনি ওই টাকা দিয়ে ২০টা লুঙ্গি আর ২০টা কাপড় কিনে আত্মীয়-স্বজন এবং প্রতিবেশীদের মধ্যে যারা গরিব তাদের দিয়ে দেন। অনেকে লুঙ্গি-কাপড়ের বদলে নগদ অর্থও দিয়ে দেন এবং একটু মিষ্টি হাসি দিয়ে, ‘ঈদের দিন বাজার করিস’। কিন্তু জাকাতের অর্থ তো ঈদের দিন গরুর মাংস কেনা নয়। জাকাতের অর্থ আরও ব্যাপক।

বলাই হয় যে, আপনি জাকাত এমনভাবে দেবেন যাতে করে যিনি জাকাত নিলেন, পরবর্তী বছর তাকে আর জাকাত নিতে না হয়। অর্থাৎ আপনি তাকে এমন পরিমাণ অর্থ দিয়ে সহায়তা করুন যাতে সে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে। আপনার উপরে যদি এক লাখ টাকা জাকাত ফরজ হয় তাহলে ওই টাকা দিয়ে আপনি আপনার কোনো গরিব আত্মীয় বা প্রতিবেশীর সন্তানকে বিদেশে পাঠিয়ে দিন অথবা তাকে একটা ব্যবসা ধরিয়ে দিন, যাতে ওই পরিবারটি বিত্তহীন অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে। এভাবে প্রতি বছর দেশের এক লাখ মানুষ যদি প্রত্যেকে একটি পরিবারের আর্থিক অবস্থা উন্নত করার দায়িত্ব নেন, হিসাব করে দেখুন, একটা সময় পরে দেশে জাকাত নেয়ার লোক পাওয়া যাবে না।

আর তখন ময়না বেগম অথবা জরিনা কিংবা ষাটোর্ধ যে বৃদ্ধা গিয়েছিলেন ফকিরাপুলে, তাদের আর ‘জাকাতযজ্ঞের’ বলি হতে হবে না।


জাকাতের উদ্দেশ্য যদি হয় বিত্তহীন মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটানো, সমাজে ধনী-গরিবের বৈষম্য কমিয়ে আনা, তাহলে আড়াইশো টাকা দামের কাপড় কিনে জাকাত দেয়ার মতো আনুষ্ঠানিকতা আখেরে কিছু মানুষের মৃত্যু, কিছু মানুষের আহত হওয়া এবং গণমাধ্যমের কিছু সংবাদ তৈরি ছাড়া আর কোনো কাজে আসে না।

আমীন আল রশীদ: সিনিয়র রিপোর্টার এবিসি রেডিও, সম্পাদক : কমিউনিটিমিডিয়া
                             ইমেইল:  aminalrasheed@gmail.com 

No comments

Powered by Blogger.