একটা কালো দিন by ড. মুহাম্মদ ইউনূস

জাতির জীবনে এটা একটা কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। আমাদের সরকার গরিব মহিলাদের মালিকানায় এবং তাদেরই তত্বাবধানে সুপরিচালিত বিশ্বসময় সুপরিচিত নোবেল পুরস্কার বিজয়ী একটি প্রতিষ্ঠান থেকে তার মৌলিকত্ব কেড়ে নিয়ে তাকে অন্য রকম প্রতিষ্ঠানে পরিণত করলো। এ দুঃখ ধারণ করার ক্ষমতা আমার নেই। কী করেছিল গ্রামীণ ব্যাংক যার জন্য তাকে তার মৌলিকত্ব হারাতে হলো?

৮০ লক্ষ গরিব মহিলা নিজেদের অর্থে শেয়ার কিনে এটার মালিকানায় অধিষ্টিত হয়েছে। ৯৭ শতাংশ মালিকানা তাদের। সরকারের মালিকানা ৩ শতাংশ। নিজেদের পয়সায় পরিচালিত এই ব্যাংক একটা বৃহৎ সমবায়ের মত। এটা নিজের অর্থে চলে। সরকার বা বিদেশ থেকে বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে এটা কোন ঋণ নেয় না, অনুদান নেয় না। তবু কেন বিশ্বব্যাপী বহুলভাবে অনুকরণকৃত এবং অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় এই প্রতিষ্ঠানকে সরকারের অন্য দশটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হলো ?

সরকার বলছেন যে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। এই অচলাবস্থা কে সৃষ্টি করেছিল? ব্যাংকের মালিকরা আইনগত প্রক্রিয়ায় একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের জন্য সিলেকশন কমিটি গঠন করেছিলেন। যেহেতু এই সিলেকশন কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁরা আমার নাম এবং অন্যান্য সদস্য হিসেবে ড. আকবর আলী খান এবং জনাব খালেদ শামসের নাম প্রস্তাব করেছিলেন, সরকারের প্রতিনিধি, বোর্ডের চেয়ারম্যান এই প্রস্তাব বোর্ডের সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করতে নারাজ থাকেন। অদ্ভুত পরিস্থিতি। গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ডে ‘‘ভেটো’’ দেয়ার ক্ষমতা আইন কাউকে দেয় নাই। চেয়ারম্যান সাহেব গায়ের জোরে ভেটো দিয়ে যেতে থাকলেন পর পর তিনটি বোর্ড মিটিং-এ। একেই বলা হচ্ছে অচলাবস্থা। তার জন্য এখন আইন সংশোধন করে পুরো ব্যাংকের ভবিষ্যৎটাই মূলতঃ চেয়ারম্যান সাহেবের হাতে তুলে দেয়া হলো।

সরকার থেকে বারবার বলা হচ্ছে ‘আমরা গ্রামীণ ব্যাংক দখল করিও নাই, করতে যাচ্ছিও না। ইউনূস সাহেব মিথ্যাচার করছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকদের কর্তৃত্ব আগের মতই আছে। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করেই চেয়ারম্যান সিলেকশান কমিটি গঠন করবেন’। পরামর্শ কখন করে, আর ভোট কখন নেয়? যখন ক্ষমতা একজনের হাতে থাকে তখন পরামর্শ করে। ভোট নেয় যখন ক্ষমতা ভোটদাতাদের কাছে থাকে। গ্রামীণ ব্যাংকের অধ্যাদেশ সংশোধন করে এখন মালিকদের ভোটদানের ক্ষমতা রহিত করে তাদেরকে ‘‘পরামর্শ’’ দেয়ার ভূমিকায় রাখা হলো। তারপর একক চেয়ারম্যান কর্তৃক তৈরী সিলেকশান কমিটি তিনটি নাম বোর্ডের কাছে দেবে। বোর্ডের সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ থাকবে যে এই প্রার্থীরা চেয়ারম্যানের চোখের দিকে তাকিয়ে কাজ করবেন। মালিকদের চোখের দিকে তাকিয়ে কাজ করবেন না। যাঁকেই তাঁরা নিয়োগ দিন না কেন-এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না।

যে বোর্ডের কাছে সমস্ত ক্ষমতা আগের মতই রয়ে গেছে বলা হচ্ছে সে বোর্ড কিছু জানার আগেই সরকার থেকে সাফ জানিয়ে দেয়া হচ্ছে যে বোর্ড সদস্যরা যা চাচ্ছেন তা হতে দেয়া হবে না। কেন হতে দেয়া হবে না? কারণ ক্ষমতা সরকারের হাতে। সরকার বলছে ‘‘সিলেকশান কমিটি’’ এক সপ্তাহের মধ্যে হয়ে যাবে। এটা কি বোর্ডের কথা, নাকি সরকারের কথা? এবং তাতে ইউনূস থাকবে না। কারণ কি? কারণ সরকার এটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের জন্য আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপন দেয়া হবে। এটা কি বোর্ডের সিদ্ধান্ত? ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বেতন আকর্ষণীয় অংকের হবে, তা না-হলে আন্তর্জাতিক মানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পাওয়া যাবে না। এটা কি বোর্ডের সিদ্ধান্ত?

অথচ সরকার বলেই যাচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাপারে সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। সরকার আইন সংশোধনের আগেই এত কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো, আইন সংশোধনের পরে কি হয় এবার আমাদের দেখার পালা।

আইনে সংশোধনী এনে সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী নিয়োগে ভূমিকা রেখে প্রকারান্তরে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনার দায়-দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিল। দুনিয়ার কোথাও নজির নাই যে বহুজনের ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী নিয়োগের ক্ষমতা ৩ শতাংশ মালিকানার অংশিদারের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।

অধ্যাদেশ সংশোধনের ব্যাপারে মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্তের পর আমি দেশের মানুষের প্রতি আবেদন জানিয়েছিলাম সরকারকে বোঝানোর জন্য, যাতে সরকার এই সংশোধনের পথে অগ্রসর না-হয়। দেশের বহু মানুষ বিবৃতির মাধ্যমে, সভা ও মানববন্ধনের মাধ্যমে, গণমাধ্যমে আলোচনা ও লেখালেখির মাধ্যমে, প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বিশেষ করে দলমত নির্বিশেষে দেশের বহু সম্মানিত মহিলা নেত্রী এব্যাপারে সরকাররের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। গরিব মহিলাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমি তাঁদের সকলকে অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি। শুধু দুঃখ রইলো যে সরকার আমাদের কারো কথা শুনলো না।

এই সংশোধনীর ফলে গ্রামীণ ব্যাংকের গৌরবময় ইতিহাসের সমাপ্তি পর্বের সূচনা হলো। এখন থেকে গরিব মহিলাদের মালিকানার ব্যাংকটি সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে পরিচালিত হবে। ইতিহাসে নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না যে এরকম পদক্ষেপের ফলে প্রতিষ্ঠানের মঙ্গল হয়েছে।

আমি আমার দুঃখ প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। গ্রামীণ ব্যাংকের অসংখ্য কর্মী সারা জীবন পরিশ্রম করে একটি স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য এই ব্যাংকটিকে দুনিয়ার একটা অনন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলেছিল। আজ এর সমাপ্তি হতে দেখে তারাও তাদের দুঃখ রাখার জায়গা পাচ্ছে না।

যে গরিব মালিকরা তাদের নগদ পয়সা দিয়ে এটার শেয়ার কিনে এটাকে ‘‘আমাদের ব্যাংক’’ হিসেবে জানতে শিখেছিল, গৌরব করতে শিখেছিল, তারা এখন জানবে যে এটা এখনো তাদের ব্যাংক বটে তবে এর ব্যাপারে মৌলিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা এখন তাদের হাতে নেই। বাড়ী আমার, আমি বাড়ীতে থাকি, কিন্তু বাড়ীর কাজকর্মে আমার কথা চলে না।

আমি আশাবাদী মানুষ। আমি হতাশ হতে চাই না। নিজের মনে আশার ক্ষীণ আলো জাগিয়ে রাখতে চাই। আমি আগের মত আবারও দেশবাসীর কাছে আহবান জানাচ্ছি যে, তারা যেন এর প্রতিকারের ব্যবস্থা করেন। আমি দেশের তরুণদের প্রতি আহবান জানাচ্ছি, তারা যেন একদিন গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকদেরকে এই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসে এবং গ্রামীণ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ তাদেরকে ফিরিয়ে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকে। গরিব মালিকদের পরিবারের তরুণরাও যেন এই প্রতিজ্ঞা করে যে, তাদের মায়েদের সম্পদ তারা তাদের মায়েদেরকে ফেরৎ এনে দেবে। তাদের ব্যাংক তাদের কাছে যেন আবার পূর্ণ ক্ষমতায় ফিরে আসে। আশাকরি ভবিষ্যতে একদিন আমাদের দেশে এমন সরকার আসবে যাদের প্রথম কাজ হবে, একটি জাতীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গরিব মহিলাদের এই ব্যাংকটিকে গরিব মহিলাদের হাতে তুলে দিয়ে এই ব্যাংকের গৌরবময় অগ্রযাত্রাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে দেবে। সেদিন দেশের সকল মানুষ স্বস্তি পাবে, গরিব মহিলাদের মঙ্গলকামী পৃথিবীর সকল মানুষ স্বস্তি পাবে।

আজ দুঃখের দিনে সেরকম একটি সুখের দিনের কথা চিন্তা করা ছাড়া মনকে সান্ত্বনা দেবার আর কিছু খুঁজে পাচ্ছি না।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস: গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ।

ইমেইল: info@yunuscentre.org

No comments

Powered by Blogger.