বুয়েটের উপউপাচার্যের অব্যাহতি ॥ ক্লাস আজকালের মধ্যেই- প্রজ্ঞাপন জারি ॥ মামলা প্রত্যাহারের ফাইনাল রিপোর্ট আদালতে জমা

বুয়েট শিক্ষক সমিতি ও শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষামন্ত্রীর দেয়া আশ্বাস অনুসারে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক হাবিবুর রহমানকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। রবিবার উপ-উপাচার্যের অব্যাহতি সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এদিকে আন্দোলনের সময়ে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের অফিসে ভাংচুর, দখল ও লুটপাটের ঘটনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের


বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা তুলে নেয়ার বিষয়েও আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। এছাড়া শনিবার উপাচার্যের অপসারণের দাবি তুলে পদত্যাগপত্র জমা দিলেও নানা নাটকের পর রবিবার বিকেলে তা ফিরিয়ে নিয়ে তিন মাসের ছুটির আবেদন করেছেন শিক্ষক নেতা আইআইসিটির সাবেক পরিচালক অধ্যাপক এসএম লুৎফুল কবির। তবে সরকারের নেয়া উদ্যোগে ক্যাম্পাসের শিক্ষার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে বলে সন্তোষ প্রকাশ আজকালের মধ্যেই ক্লাসে ফিরছে শিক্ষক সমিতি। আজই শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরবেন বলে আশা করে বলেছেন, তাদের প্রত্যাশা মতো আমরা কাজ করেছি। তারাও আমাদের প্রত্যাশা মতো কাজ করবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি।
এর আগে ‘শিক্ষামন্ত্রীর উদ্যোগে আমরা আশ্বস্ত হয়েছি। আমরা কর্মসূচী স্থগিত করছি’ শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে
বৈঠক শেষে শিক্ষক সমিতি ও শিক্ষার্থীদের এমন স্পষ্ট ঘোষণার পরেও অচলাবস্থা কাটছিল না বুয়েটের। উপ-উপাচার্যের অব্যাহতি ও মামলা প্রত্যাহারের আশ্বাসের পর শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী দুইপক্ষই ঘোষণা দিয়েছিল ‘আমরা আশ্বস্ত হয়েছি, আমরা সন্তুষ্ট।’ শিক্ষক সমিতি আন্দোলন বন্ধ করে শিক্ষা কার্যক্রম শুরুরও ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু এখন নতুন করে অচলাবস্থা জিইয়ে রাখার কৌশল নিয়েছেন বিতর্কিত কিছু নেতা। শনিবারই অভিযোগ ওঠে, এর অংশ হিসেবেই ঘোষণা অনুসারে কাজে যোগদান না করে উল্টো কৌশলে সরকারকে দাবির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের শর্ত দেয়া হয়েছে। অচলাবস্থা জিইয়ে রাখতেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পর্কহীন এমনকি যে দাবি কখনই আসেনি সেই হলসহ প্রশাসনিক পদে রদবদলের আবদার তোলা হয়েছে। সরকারবিরোধী বিতর্কিত শিক্ষক নেতারা শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে হলসহ প্রশাসনিক পদে বিগত বিএনপি-জামায়াত আমলের সেই ব্যক্তিদের নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। প্রশ্ন ওঠে এই আন্দোলন কতটুকু শিক্ষার্থীদের স্বার্থের তা নিয়েও। এমন অবস্থায় শনিবারই শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে সাক্ষাত করে শনিবার আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কোন অনৈতিক দাবির কাছে মাথা নত না করার অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। সকালে মিন্টো রোডে শিক্ষামন্ত্রীর বাসভবনে মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ। তিনি বলেন, দীর্ঘ ৫ মাস ধরে বুয়েটে অস্থিরতা চলছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা সকলেই ক্লাসে ফিরে যেতে উন্মুখ। কিন্তু কোন অবৈধ শক্তি যেন শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরা অনিশ্চিত করতে না পারে সেজন্যই মন্ত্রীকে অনুরোধ করেছে ছাত্রলীগ। কোন অনৈতিক দাবি মানতে গিয়ে দেশের এই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির যেন পরিবেশ নষ্ট না হয় সেজন্য মন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি। ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে সকল ধরনের সহযোগিতা করবে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, দ্রুতই বুয়েটে ক্লাস শুরু হবে এবং স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমরা কথা বলছি। শনিবার শিক্ষামন্ত্রী সরকারের অবস্থান তুলে ধরে বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার অনুসারে কাজ চলছে। উপ-উপাচার্যের অব্যাহতির কাজ চলছে। মামলা প্রত্যাহারেও আবেদন করেছে কর্তৃপক্ষ। আশা করি শিক্ষক-শিক্ষার্র্থীরা দ্রুত শিক্ষা কার্যক্রমে যোগ দেবেন। কিন্তু শনিবার বিকেলে হঠাৎ চাকরি থেকে অব্যাহতি চেয়ে রেজিস্ট্রারের কাছে আবেদন করেন আন্দোলনকারী শিক্ষক অধ্যাপক লুৎফুল কবির। গোপনে পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট খুলে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি ও অশ্লীল কথাবার্তা লেখার জন্য কয়েকদিন আগে আইআইসিটির পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল এই শিক্ষককে। উপাচার্য ও উপ-উপাচাযের্রর কক্ষে হামলা, ভাংচুরের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আসামিও ছিলেন তিনি।
শনিবার হঠাৎ তিনি সাংবাদিকদের জানান, উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে তিনি চাকরি থেকেই অব্যাহতি চেয়েছেন। রবিবার দুপুর পর্যন্ত এ বিষয়টি নিয়ে নানা খবর প্রচার হতে থাকে। উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি প্রচার করলেও খবর ছড়িয়ে পড়ে এই শিক্ষক আসলে ইসলামী ব্যাংকে কনসালটেন্ট হিসেবে যোগ দিচ্ছেন তাই পদত্যাগ করছেন। এরপর রবিবার বিকেলেই পদত্যাগপত্র ফিরিয়ে নিয়ে তিন মাসের ছুটির আবেদন করেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান এবং শিক্ষার্থীরা আমাকে বুয়েট না ছাড়তে অনুরোধ করেছেন। তাই আমি পদত্যগপত্র প্রত্যাহার করেছি। তবে আমি তিন মাসের ছুটিতে যাচ্ছি। এর মধ্যে উপাচার্য অপসারিত না হলে আমি সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করব।
এদিকে সরকারের ঘোষণা অনুসারেই রবিবার বিকেলে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক হাবিবুর রহমানকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে অধ্যাপক হাবিবুর রহমানকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হলো। তিনি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক পদে প্রত্যাবর্তন করবেন। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দেয়া মন্ত্রীর একটি প্রতিশ্রুতি পূরণ হলো। এর আগে দুপুরেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা তুলে নেয়ার বিষয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় শাহবাগ থানা পুলিশ। ঠিক এমন এক অবস্থায় বুয়েটের দীর্ঘ অচলাবস্থার অবসান হবে বলে মনে করা হচ্ছে। আজকালের মধ্যেই সচল হতে পারে বুয়েট। সরকারের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরাও। তারা বলেছেন, আমরা এখন ক্লাসে ফিরতে প্রস্তুত। সরকারের নেয়া উদ্যোগে ক্যাম্পাসের শিক্ষার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে বলে সন্তোষ প্রকাশ করে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আশারাফুল ইসলাম বলেছেন, আশ্বাস পূরণের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। আমরা সরকারের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। আমরা আশা করি এখন দ্রুতই ক্লাস শুরু করা সম্ভব। সোমবারই (আজ) ক্লাসে ফিরছেন কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে সেক্রেটারি বলেন, একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুসারে ক্লাস চালু করতে বুয়েটের কিছু নিয়ম-কানুন আছে। তবে আমরা প্রস্তুত। উপাচার্য তথা প্রশাসন যেদিনই নোটিস দেবে, যেদিনই মিটিং ডাকবেন সেদিনই আমরা যাব। অন্যদিকে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এসএম নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, আজকালের মধ্যেই তিনি নোটিস দেবেন। একই সঙ্গে বৈঠকও ডাকা হবে।
উপ-উপাচর্যের অব্যাহতি এবং মামলা অকার্যকর হওয়ায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আজই ক্লাসে ফিরবেন বলে আশা প্রকাশ করছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। উপ-উপাচার্য অধ্যাপক হাবিবুর রহমানের অব্যাহতির প্রজ্ঞাপন জারির পর সচিবালয়ে শিক্ষামন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, আমি আশা করব, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আগামীকালই (আজ সোমবার) ক্লাসে ফিরে যাবেন। আগামীকাল তাদের ক্লাসে দেখতে চাই। আমি আশা করি, তারা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন। শিক্ষার্থীদের অনেক সময় নষ্ট হয়েছে, ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি পোষানোর জন্য যা যা করা দরকার তাঁরা তাই তাই করবেন। মন্ত্রী জানান, বুয়েটের ঘটনায় দায়ের হওয়া দুটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়া হয়েছে। তাই মামলাও আর নেই। বুয়েটে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে বাড়তি নজর দেয়া হবে জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, শিক্ষার্থীরা যেন দ্বিধাগ্রস্ত না থাকে সেজন্য বাড়তি নজর দেয়া হবে। শিক্ষার্থীরা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ক্লাসে ফিরে যাবে, বুয়েটে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

No comments

Powered by Blogger.