বিমানে ইচ্ছামতো এজেন্ট নিয়োগ-সুযোগ বাড়ছে দুর্নীতির by আশরাফুল হক রাজীব

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে জেনারেল সেলস এজেন্ট (জিএসএ) নিয়োগের কোনো নীতিমালা নেই। এ সুযোগে বিমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ইচ্ছামতো জিএসএ নিয়োগ করে। অভিযোগ আছে, আকাশ পরিবহন ব্যবসায় লোভনীয় এ নিয়োগ পেতে বিদেশি এজেন্টগুলো বিমানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বিমানসংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ধরনা দেয়। বড় অঙ্কের টাকা খরচ করে তারা বিমানের জিএসএ হতে চায়।


জিএসএ বিমানের প্রতিটি টিকিট বিক্রি থেকে ৭ শতাংশ হারে কমিশন পায়। তারা মালপত্র পরিবহনের জন্য কার্গো বুকিং দেয়। ভ্রমণ কর আদায় করে যাত্রীদের কাছ থেকে। ফি আদায়ের বিনিময়ে তাদের অতিরিক্ত ব্যাগ বহনের আনুমোদন দেয়। এ ছাড়া জ্বালানি তেল সংগ্রহ, বিমান ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার, জরুরি ভিত্তিতে যন্ত্রপাতি কেনাসহ বিদেশে বিমানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব বিষয় দেখভাল করে বৈধভাবে শত শত কোটি টাকা আয় করে। বৈধভাবে আয়ের পাশাপাশি প্রতিটি ধাপে তাদের রয়েছে অবৈধ আয়ের সুযোগ। বিমানের এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশে জিএসএ এজেন্টরা অল্প সময়েই বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়ে যায়। এ কারণেই জিএসএ সংস্থাগুলো তাদের এজেন্টশিপ পাওয়ার জন্য শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে বলে বিমানের মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
এত গুরুত্বপূর্ণ এই জিএসএ নিয়োগে কোনো নীতিমালা না থাকার কারণ জানতে চাইলে বিমানের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসাদ্দেক আহমেদ গত রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'জিএসএ নিয়োগের জন্য আলাদা কোনো নীতিমালা নেই। যখন প্রয়োজন হয় তখন বিমানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় বিবেচনায় নিয়েই জিএসএ এজেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়। কখনো পুরনো এজেন্টের চুক্তি নবায়ন করা হয়, আবার কখনো কখনো নতুন করে টেন্ডার বা আরএফপি আহ্বান করা হয়।'
বিমানের সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, এ মুর্হূতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক স্টেশনে জিএসএ নিয়োগের জন্য টেন্ডার না ডেকে পুরনো এজেন্টের চুক্তি নবায়নের প্রক্রিয়া চলছে। এর মধ্যে আছে বিমানের সবচেয়ে লাভজনক এবং ব্যস্ততম স্টেশন সৌদি আরবের জেদ্দা। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) আজমান ও হংকং স্টেশন রয়েছে। আজমানে জিএসএ হিসেবে কাজ করছে আল-আহলিয়া ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম এজেন্সি। তারা বিমানের সঙ্গে রয়েছে ১৯৯৮ সাল থেকে। আগামী ৩০ নভেম্বর তাদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। হংকংয়ে জিএসএ (কার্গো) হিসেবে কাজ করছে ইউনিয়ন ট্রাভেলস কম্পানি। তারা ১৯৮৯ সাল থেকে জিএসএর দায়িত্ব পালন করছে। জেদ্দা স্টেশনে জিএসএর দায়িত্ব পালন করছে সৌদি আরবের ইলাফ এভিয়েশন। ইলাফ ১৫ বছর ধরে জিএসএ হিসেবে কাজ করছে। আগামী ২৪ অক্টোবর তাদের মেয়াদ শেষ হবে। নতুন করে টেন্ডার দিয়ে জিএসএ নিয়োগের নির্দেশনা বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হলেও তা আমলে নেয়নি বিমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। তারা কোনো রকম যাচাই-বাছাইয়ে না গিয়ে ইলাফ এভিয়েশনের চুক্তিই নবায়ন করছে। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই তাদের চুক্তি নবায়নের কাজ শেষ হবে বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির একজন সদস্য সৌদি আরবে গিয়ে ইলাফ এভিয়েশনকেই জিএসএ হিসেবে বহাল রাখার প্রতিশ্রুতি দেন। এ কাজে তাঁকে সহায়তা করেছেন বিমানের জেদ্দা স্টেশনের এরিয়া ম্যানেজার আশরাফ আলী। গত মাসে জেদ্দার বাংলাদেশি কমিউনিটি এবং জেদ্দায় কর্মরত ১৫০টি ট্রাভেল এজেন্ট বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে একটি আবেদন পাঠিয়েছে। সেখানে তারা জেদ্দায় জিএসএ হিসেবে ইলাফের চুক্তি নবায়ন না করার জন্য অনুরোধ করেছে। আবেদনকারীরা সরকারকে জানিয়েছে, ইলাফ তিনটি ট্রাভেল এজেন্টের মাধ্যমে জেদ্দায় বিমারে টিকিট বিক্রি করে। অবশিষ্ট দেড় শতাধিক এজেন্টকে টিকিট বিক্রির দায়িত্ব দেওয়া হয় না। ফলে জেদ্দার যেকোনো জায়গা থেকে টিকিট সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। এ কারণে বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে বিদেশি এয়ারলাইনস বেছে নিচ্ছেন। একই সঙ্গে জিএসএ হিসেবে ইলাফ বিমানের বাজার সম্প্রসারণের কোনো উদ্যোগ ১৫ বছরে নেয়নি বলেও তারা জানিয়েছে।
বিমানে কোনো কর্মকর্তা বিদেশের কোনো পদে তিন বছরের বেশি থাকতে পারেন না। কিন্তু জেদ্দা স্টেশনের এরিয়া ম্যানেজার তিন বছরের বেশি সময় ধরে সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন। আশরাফ আলীকে প্রত্যাহারের জন্য গত আগস্টে অনুষ্ঠিত বোর্ড সভায় নির্দেশ দিয়েছিলেন বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব আতাহারুল ইসলাম। সেই নির্দেশনা আমলে না নেওয়ায় পরের বৈঠকে বিমান ও পর্যটনসচিব ক্ষোভ প্রকাশ করেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমান ও পর্যটনসচিব আতাহারুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'জেদ্দার এরিয়া ম্যানেজার আশরাফ আলীকে আবারও প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্ত করার জন্য কমিটি গঠন করা হচ্ছে।'
বর্তমানে বাইরে ১৮টি দেশে বিমানের অফিস রয়েছে। আর জিএসএ রয়েছে ৯টি স্টেশনে। জিএসএগুলোর সঙ্গে বিমানের বার্ষিক লেনদেন কয়েক শ কোটি টাকার মতো। এ গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরটির সঙ্গে চুক্তিতে উপনীত হওয়ার জন্য কোনো নীতিমালা নেই বিমানের। ১৯৯৮ সালে বিমানের ২২৯তম বোর্ড সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই জিএসএ নিয়োগ দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়েছে, বিমানের সংশ্লিষ্ট কান্ট্রি ম্যানেজার আগ্রহী এজেন্টদের কাছ থেকে জিএসএ হওয়ার আবেদন সংগ্রহ করবেন। কমপক্ষে তিনটি আবেদন থাকতে হবে। আকাশ পরিবহন বাণিজ্যের সঙ্গে তাদের দীর্ঘ সম্পর্ক থাকতে হবে। কান্ট্রি ম্যানেজারের পাঠানো প্রস্তাব খুঁটিনাটি পরীক্ষা করা হবে বিমানের মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস, ফিন্যান্স ও আইনি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে। ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জিএসএ চুক্তি হবে তিন বছরের জন্য। তাদের কার্যক্রম ভালো হলে পরের মেয়াদের জন্য চুক্তি নবায়ন করা যাবে।
বিমান কর্মকর্তাদের দাবি, জিএসএদের পরিচালনার জন্য একটি নীতিমালা থাকা জরুরি। প্রায় ১৫ বছর আগে নেওয়া সিদ্ধান্তের আলোকে জিএসএ নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে বলেই দুর্নীতির সুযোগ বেশি সৃষ্টি হচ্ছে। কর্মকর্তারা আরো জানিয়েছেন, কাতারের দোহায় বিমানের জিএসএ হিসেবে ন্যাশনাল ট্রাভেল ব্যুরো কাজ করছে ১৯৭৬ সাল থেকে। সৌদি আরবের রিয়াদে এসিই ট্রাভেল ১৯৮৯ সাল থেকে এবং ওমানের মাস্কাটে ওমান ট্রাভেল ব্যুরো ১৯৮৯ সাল থেকে বিমানের জিএসএ হিসেবে কাজ করছে। জাপান ও যুক্তরাজ্যের লন্ডনে ২০০৮ সালে নতুন করে জিএসএ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.