'আমুল' বিপল্গবের 'দুধওয়ালা' by আসিফ আহমেদ

ছয় মাসের চুক্তি শেষ। ২৮ বছরের যুবকটি ব্যাগ গুছিয়ে সোজা মুম্বাই রওনা দেওয়ার জন্য তৈরি। এমন সময় স্থানীয় বাসিন্দা ত্রিভুবন দাসের আবির্ভাব। সনির্বন্ধ অনুরোধ, 'আর ক'টা দিন থেকে যাও। আমাদের সমবায়টা তা হলে একটু মজবুত করে নেওয়া যেত!'


১৯৪৯ সালের গুজরাত। বন্ধু ত্রিভুবন দাসের অনুরোধ ফেলতে না পেরে ভার্গিজ কুরিয়েন সেই যে থেকে গেলেন, তার থেকেই জন্ম নিল একটা বিপল্গব। ভারতের গ্রামীণ সমবায় শিল্পোদ্যোগের ইতিহাসকে 'আমূল' বদলে দেওয়ার বিপল্গব, যার দৌলতে গুজরাতের গ্রামে ৩২ লাখ মানুষ আর্থিকভাবে স্বয়ম্ভর, যার দৌলতে ভারত বিশ্বের পহেলা নম্বর দুধ উৎপাদক দেশ। ৯০ বছর বয়সী কুরিয়েনের মৃত্যুতে সেই বিপল্গবের একটা যুগ সমাপ্ত হলো।
সোমবার আনন্দবাজার ভার্গিজ কুরিয়েনের মৃত্যু সংবাদ দিয়ে লিখেছে, ১৯২১ সালে কেরলের কোঝিকোডয়েতে তার জন্ম। বিজ্ঞানে স্নাতক। জামশেদপুরে চাকরি করতে করতেই সরকারি স্কলারশিপ পান ডেয়ারি ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনার জন্য। বেঙ্গালুরুর 'ইম্পিরিয়াল ইনস্টিটিউট অব অ্যানিমাল হাসব্যানড্রি অ্যান্ড ডেয়ারিং'-এ পাঠ শেষে আমেরিকার মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়। সেখান থেকে ফিরে চুক্তিমাফিক দুধ থেকে ক্রিম তৈরির একটি সরকারি কারখানায় ঢুকলেন। ত্রিভুবন দাসের সঙ্গে সেখানেই আলাপ।
শুরু হয়েছিল মাত্র দুটি গ্রাম নিয়ে, দিনে ২৪৭ লিটার দুধ আসত তখন। ১৯৫৫ সালের মধ্যে এলাকা যেমন বাড়ল, তেমনই বাড়ল দুধের পরিমাণ। দৈনিক ২০ হাজার লিটার। গরুর দুধে আটকে না থেকে মোষের দুধকে কাজে লাগানোর পথিকৃৎ কুরিয়েনের সমবায়ই। কুরিয়েনরা অনুভব করলেন, এবার একটা 'ব্র্যান্ডনেম' দরকার। ১৯৫৫ সালে আত্মপ্রকাশ করল ব্র্যান্ড 'আমুল'!
শ্বেত বিপল্গব, অপারেশন ফ্লাড, ন্যাশনাল ডেয়ারি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড, গুজরাত কোঅপারেটিভ মিল্ক মার্কেটিং ফেডারেশন... আরও যত ধাপই পেরোক না কেন কুরিয়েনের কর্মযজ্ঞ, শুরুটা ওই তিনটি বর্ণে 'আমুল'। 'আমুলে'র সাফল্যে উদ্দীপিত হয়েই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী উদ্যোগী হলেন ন্যাশনাল ডেয়ারি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড বা এনডিডিবি (১৯৬৫) গড়ার কাজে। কুরিয়েনই তার কর্ণধার হলেন। তার নেতৃত্বেই ১৯৭০ সালে দেশজুড়ে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় 'অপারেশন ফ্লাড'-এ নামল এনডিডিবি। গুজরাতে অবশ্য 'আমুল'-মডেল তার আগেই ছড়িয়ে পড়েছিল। গোটা রাজ্যের দুগ্ধ সমবায়গুলোকে এবার এক ছাতার তলায় আনলেন কুরিয়েন। ১৯৭৩ সালে গড়ে উঠল গুজরাত কোঅপারেটিভ মিল্ক মার্কেটিং ফেডারেশন। গোটা গুজরাতের প্রতিনিধি হয়ে উঠল 'আমুল'।
এই সাফল্যের রহস্য? উৎপাদনের গুণমান তো বটেই, কুরিয়েন নিজেও সবচেয়ে বেশি জোর দিতেন ওটার উপরে। সেই সঙ্গে ছিল অনবদ্য প্রচার কৌশল। পাঁচ দশক পেরিয়ে গেল, সাদার উপরে লাল ছিট ছিট জামা পরা বাচ্চা মেয়েটা কোনো সেলিব্রিটির মুখ ধার না করেই নিজের জায়গাটা ধরে রেখেছে। কুরিয়েন বিজ্ঞাপন সংস্থাকেও পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন যে!
কুরিয়েনের জীবন শুধু স্বপ্নকে সত্যি করা নয়, স্বপ্নকে ক্রমাগত ছাড়িয়ে যাওয়ার আখ্যান। একদিকে 'আমুল' গুঁড়া দুধ-মাখন থেকে শুরু করে ঘি, চকোলেট, চিজ, আইসক্রিম, দই... হালে টেট্রাপ্যাকের দুধ! অন্যদিকে কুরিয়েন ১৯৭৯-এ তৈরি করলেন ইনস্টিটিউট অব রুরাল ম্যানেজমেন্ট। আশির দশকে শুরু হলো এল সি জৈন, মোহন ধারিয়া এবং কুরিয়েনের 'সমবায় প্রয়াস' (তার চাপেই শেষমেশ কেন্দ্রীয় সরকার 'বহু-রাজ্য সমবায় সংশোধন আইন'টি পাস করে)। বাদ গেল না চলচ্চিত্রও!
শ্যাম বেনেগাল তৈরি করেন বিখ্যাত ছবি 'মন্থন' (১৯৭৬)। গল্পটা লিখতে সাহায্য করেন কুরিয়েন নিজেই। ছবির খরচ জোগান, যাদের নিয়ে গল্প, তারাই। গুজরাত সমবায় প্রকল্পের পাঁচ লাখ দুধ উৎপাদক দুই টাকা করে চাঁদা দিলেন। গিরিশ কারনাড-স্মিতা পাটিলকে নিয়ে তৈরি হলো 'মন্থন'।
দুধ বিপল্গবেরই তো আর এক নাম কুরিয়েন। 'আমুল'-এর বার্ষিক ব্যবসার পরিমাণ আজ আড়াইশ' কোটি টাকা! অথচ নিজে বলতেন, 'দুধ একদম খাই না।' কুরিয়েন বিশ্বাস করতেন, উন্নয়নের সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে উন্নয়নের হাতিয়ারকে হাতে তুলে দেওয়া। কুরিয়েনের ভাবনা_ 'আমি ক্ষমতায়নের ব্যবসা করি, দুধ তার উপাদান মাত্র।'
 

No comments

Powered by Blogger.