ভিনদেশ থেকে আসা ছয় মাসের অতিথি ওরা, নিধন হচ্ছে ফাঁদে পড়ে- হারিয়ে যাচ্ছে জলাভূমির বুনোহাঁস by আবু জাফর সাবু

শীতকালের অতিথি বর্ণালি হাঁস গোত্রের পাখিরা হারিয়ে যাচ্ছে। শীত মৌসুমে ভিনদেশ থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসা এদেশের মিঠাপানির খাল, বিল, নদী, হাওড়ের ছয় মাসের অস্থায়ী বাসিন্দা এরা। নানা প্রজাতির হাঁসের আগমন ইদানীং বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে বলে পাখি বিজ্ঞানীরা পরিসংখ্যান থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন।


হাঁসের মাংস সুস্বাদু হওয়ায় মানুষের রসনা তৃপ্তিতে অবৈধ শিকারি এবং পাখি ব্যবসায়ীদের ফাঁদে ধরা পড়ে ব্যাপক হারে নিধন হচ্ছে। এছাড়া পানিশূন্যতা, জলাভূমিতে ফসল ও মাছ চাষ, জলাভূমি ভরাট করে অবকাঠামো গড়ে তোলা, খাদ্য সঙ্কটসহ নানাবিধ কারণে সুন্দর এই পাখির আগমন ব্যাপক হারে কমে গেছে।
এতদসত্ত্বেও যে সব হাঁস গোত্রের পাখির কলকাকলিতে আমাদের বিল, হাওড়, চরাঞ্চল এবং বনাঞ্চল মুখোরিত হয়ে ওঠে শীত মৌসুমে, সেগুলো হলো সরালী হাঁস, লেনজা, লালশির, নীলশির, পাতরি, জিরিয়া, রাজহাঁস, ভাদি হাঁস, চখাচখি, রাঙ্গামুড়ি, ভূতিহাঁস, বামুনিয়া হাঁস, চীনা হাঁস, পান্তামুখী হাঁস উল্লেখযোগ্য।
সরালী হাঁস ॥ সরালী প্রজাতির হাঁস এখনও বিভিন্ন জলাশয়ে দেখা মেলে, তবে সংখ্যায় কম। এদের মধ্যে আবার কয়েকটি প্রজাতি রয়েছে। যেমন সরালী, বড় সরালী, ছোট সরালী বা গেছো সরালী। এদের মধ্যে ছোট সরালীর সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম। ৫১ সেন্টিমিটার লম্বা এই হাঁসের চোখ দুটো লালচে পুঁতির মতো। মাথাসহ গলা বুকের পালক মেরুন রঙের আর পাখার পালক কালচে এবং মাঝে মাঝে মেরুন মিশেল। এরা সাধারণত গাছের ফাঁকফোকরে বাসা বাঁধে। সে জন্য এদের গেছো হাঁস গোত্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এদের ইংরেজী নাম লেসার হুইসলিং ডাক এবং বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে ডেনডিওসিগনা জাভানিকা।
লেনজা হাঁস ॥ এই সুন্দর হাঁসটির দেখা মেলে আমাদের দেশে। তবে সুস্বাদু মাংসের কারণে এরা শিকারির কাছে যথেষ্ট মূল্যবান। এদের মাথার অংশের পালক হাল্কা চকোলেট রঙের এবং গলা ও বুকের পালক সাদা। পিঠে ও পাখায় পালকের রং উজ্জ্বল পিঙ্গল এবং ডানায় সুদৃশ্য টানা টানা কালো রেখা। এদের চেনার আলাদা বৈশিষ্ট্য হলো লেজের অগ্রভাগের লম্বা পালক। এরা ৫০ থেকে ৫৪ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এদের ইংরেজী নাম হচ্ছে পিনটেইল আর বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে এ্যানাসাকুটা লিন্যাউস। এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে জলজ শ্যাওলা, শস্য দানা, বীজ, মাছ ও পোকা মাকড়। এরা জলাভূমির আশপাশে বাসা বানায়।
নীলশির হাঁস ॥ এই প্রজাতির হাঁস অনেকটা আমাদের গৃহপালিত দেশী পাতিহাঁসের মতোই। বিশেষ করে পুরুষ হাঁসের মিল বেশি পরিলক্ষিত হয়। এই প্রজাতির অন্য হাঁসটির নাম লালশির। নীলশির হাঁসের পুরুষের এবং স্ত্রীর মাথার পালক উজ্জ্বল এবং চকচকে নীল রঙের। গলায় চক্রাকারে সাদা রেখা। এছাড়া গলার কাছের পালক চকোলেট রঙের হলেও বুক লেজের নিচের ভাগের পালক সাদা। পাখায় নীল ধূসর এবং পিঙ্গল রঙের মিশেল পালক আবার লেজের ওপরের পালক নীল এবং অগ্রভাগের পালক বাঁকানো। এই প্রজাতির পুরুষরা বিচিত্র বর্ণালি পালকে সুসজ্জিত বলেই দর্শনীয়। পক্ষান্তরে নীলশির পুরুষ হাঁসের মাথা, গলা, বুকের নিচের অংশের পালকের রং চকোলেট হলেও পিঠ, ডানা ও লেজের পালক নীল রঙের। এর বিশেষ নামের কারণ ঠোঁটের ওপর কপালে উজ্জ্বল লাল রঙের তিলক। তবে এদের বুক-লেজের নিচের অংশও সাদা রঙের। এদের পায়ের রং নীল হলেও নীলশিরের পা দুটো উজ্জ্বল লাল রঙের। এদের ইংরেজী নাম হচ্ছেÑ উইজিওন আর নীলশির হাঁসকেই ইংরেজিতে বলে মালার্ড এবং বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে এ্যানাস টাইনকস লিন্যাউস।
রাজহাঁস ॥ হাঁসের মধ্যে এদের গোত্র আলাদা এবং সাইজ এবং বৈশিষ্টে ভিন্নতর। রাজহাঁসের অন্যান্য প্রজাতির মধ্যে রয়েছে সাদা কপাল রাজহাঁস। এই প্রজাতিটি বিরল তালিকাভুক্ত। তবে ধূসর রাজহাঁস এবং রাজহাঁস আমাদের দেশে এখন আসে তাদের আদি আবাস থেকে এখানে শীত কাটাতে। পরিযায়ী এই পাখিটি লম্বায় ৭০ থেকে ৭৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এদের ইংরেজী নাম হচ্ছেÑ বার হেডেস গুজ, আর বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছেÑ আনসার ইনডিকাস। ধূসর, নীল ও কালো রঙের মিশেল এদের পিঠের পালক। মাথা ও নিচের পেছনের অংশের পালক সাদা তবে মাথায় চোখের গোড়া থেকে কালো দুটো রেখা থাকে। বুক আর গলার নিচের অংশের পালক পিঙ্গল। রাজহাঁসের গলা আর পা বেশি লম্বা এবং ঠোঁট মোটা ও চেপ্টা অন্যসব হাঁসের চেয়ে। অন্য দুই প্রজাতির রাজহাঁসের পিঠ, গলা, বুকের পালক ধূসর, পা লাল এবং অপেক্ষাকৃত মজবুত। এদের খাদ্য তালিকায় কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। রাজহাঁস ঘাস এবং গাছের পাতা, শ্যাওলা, পোকা, জলজ উদ্ভিদ, শস্য দানাসহ অন্য হাঁসদের খাদ্য তালিকায় উল্লেখিত খাদ্য খেয়ে থাকে। এরা মাটিতে ঝোপঝাড়ে লুকানো বাসায় বড় বড় সাদা রঙের ডিম দেয়।
চখাচখি ॥ এরা হাঁস শ্রেণীভুক্ত হলেও এদের গোত্র আলাদা। এরা স্ত্রী পুরুষ দীর্ঘকাল জোটবদ্ধ হয়ে থাকে এবং সব সময় একসঙ্গেই বিচরণ করে। সে কারণে পাখিদের মধ্যে প্রেমিক জুটি আখ্যায়িত করে বাংলা সাহিত্যেও চখাচখির কথা ঠাঁই পেয়েছে। এদের আদি নিবাস হিমালয়ের শীতপ্রধান এলাকাসহ তিব্বতের মালভূমি অঞ্চল। আগে এদেশে অনেক বেশি সংখ্যায় দেখা মিললেও এখন এদের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। তবে আশার কথা, উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র নদের চরাঞ্চলেও এদের দেখা মেলে। ৬০ থেকে ৬৫ সেন্টিমিটার লম্বা চখাচখির ইংরেজী নাম রাডি শেলডাক আর বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে তডোমা ফেরজিনা। এদের গায়ের রং হাল্কা বাদামি ও সাদা রঙের মিশেল। পা, লেজে অগ্রভাগ কালো। স্ত্রী-পুরুষের গায়ের রং এক হলেও পুরুষ চখার গলায় কালো বলয় দেখা যায়। এদের পুরুষ হাঁসের নাম চখা আর স্ত্রীটির নাম চখি। একটি অন্যটির চোখের আড়াল হলেই উচ্চস্বরে ডাকাডাকি করে খোঁজে। এর মধ্যে অন্য এক প্রজাতি আছে, যার নাম শাহ চখা বা কোথাও কোথাও সচকা নামে পরিচিত।
জিরিয়া হাঁস ॥ দেশী হাঁসের মতো এ প্রজাতিটির ইংরেজী নাম হচ্ছে গারগানি আর বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছেÑ এ্যানাস কয়েরকুযেডুলা লিন্যাউস। সর্বত্রই এই হাঁসের দেখা মেলে। ৩৫ থেকে ৩৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা বুনো হাঁসা গোত্রের পাখি জিরিয়া হাঁসের ঠোঁট ও পা কালো রংয়ের আর পাখার পালক পাটকিলে আর মাঝে মাঝে তাতে যুক্ত হয়েছে উজ্জ্বল নীল রঙের পালক। এছাড়া এদের বুক ও লেজের অংশের পালক ধূসর। লেজ আমাদের দেশী হাঁসের চেয়ে কিছুটা লম্বা।
এছাড়া পান্তামুখী হাঁস, পিয়ং হাঁস, পাতারি হাঁস, ভাদি হাঁস নানা বর্ণালি পালকে মোড়ানো সুদৃশ্য এবং আকর্ষণীয় জলচর হাঁস প্রজাতির পাখি। যাদের এদেশে আগমন সম্প্রতি বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। এদের মধ্যে ভাদি হাঁস এখন বিরল এবং বিপন্ন প্রজাতির পাখিতে পরিণত হয়েছে। সেই সঙ্গে বিরল প্রজাতির তালিকায় রয়েছে বোঁচা ও ফুট্কি হাঁস। তবে বামুনীয়া হাঁস, রাঙাবুড়ি, ডুবুরি হাঁস, বালি হাঁস, সাদা হাঁস, গোলাপি শির প্রজাতির হাঁসের দেখা এখনও মেলে।

No comments

Powered by Blogger.